প্রশান্তি ডেক্স॥ একজন সচিবকে গত মাসে (অক্টোবর) বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কয়েক দিন পরই তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে আরও কয়েকজনকে অব্যাহতি ও শাস্তি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কী কারণে হঠাৎ পুলিশ কর্মকর্তাদের অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। যদিও ২০২১ সালের জুলাই থেকে এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ মাসে এক হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। শাস্তি দেওয়া হয়েছে আরও এক হাজার ২০০ পুলিশ সদস্যকে।
গত ১৮ অক্টোবর পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার তিন জন কর্মকর্তা মুহাম্মদ শহীদুল্ল্যাহ চৌধুরী, মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা ও মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকীকে অবসরে পাঠায় সরকার। কারণ হিসেবে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় জনস্বার্থে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
তাদের অব্যাহতির পর নানামুখী আলোচনা শুরু হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এর প্রকৃত কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে আলোচনার ডালপালা বাড়তে থাকে। এই তিন জনের অব্যাহতির রেশ না কাটতেই আরও কয়েকজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লিয়েনে কর্মরত পুলিশ সুপার উৎপল দত্তকে ২৬ মার্চ থেকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গত ৩১ অক্টোবরে। এছাড়াও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুব হাকিম এবং সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলমগীর আলমকে অবসর দেওয়া হয়। কারও ক্ষেত্রে ২৫ বছর চাকরি পূর্ণ হওয়ার কথা বলা হয়। কারও ক্ষেত্রে বলা হয়, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, অব্যাহতি ও দণ্ড দেওয়ার বিষয়টি নিয়মিত বিষয়। এর আগেও একই কারণে অনেককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু তখন এসব বিষয় আলোচনায় আসেনি। যেমন, দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় ডিআইজি মিজানুর রহমানকে রাষ্ট্রপতির আদেশে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি (২০২২) থেকে সরকারি চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে গত ৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৪ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার তদন্ত শেষে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনসহ একাধিক অভিযোগে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ওই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি (২০২২) তিন বছরের কারাদণ্ড দেন।
এছাড়াও অসদাচরণ, দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রমের অভিযোগে অনেককে বিভিন্ন দণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তথ্য সচিবকে অব্যাহতি দেওয়ার পরপরই পুলিশের কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশে ‘সন্দেহজনক’দের সরিয়ে দেওয়ার কথাও আলোচিত হয় সর্বত্র।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি ও বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত রয়েছেন মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন। তিনি এসআই সাফায়েত হোসেনের স্ত্রী তাহেরা স্বপ্নাসহ বিভিন্ন নারীর সঙ্গে পরকীয়াসহ অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন। প্রায় প্রতি রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফিরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার অভিযোগে স্ত্রী ফারজানা শারমিন হোসেন চারটি মামলা দায়ের করেন। পরে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে এসআই শাফায়েত হোসেনের স্ত্রী তাহেরা স্বপ্নাকে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে তাহেরাকে দিয়ে তার স্বামীকে তালাক প্রদান করান। এতে পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার বিষয়টি বিভাগীয় তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এসব অভিযোগে ২০১৮ সালের ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ প্রমাণিত হওয়ায় বিধিমালার ৪(২) উপবিধি (১)(ক) উপবিধি অনুসরণে তাকে ‘তিরস্কার’ দণ্ড দিয়ে গত ২৭ অক্টোবর (২০২২) প্রজ্ঞাপন জারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গাজীপুর মহানগর পুলিশে (জিএমপি) উপ-কমিশনার হিসেবে কর্মরত মিজানুর রহমান দিনাজপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় একটি বিকাশ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জুয়াড়িদের কাছ থেকে ১১ লক্ষাধিক টাকা নিয়েছিলেন। বিভাগীয় তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ‘অসদাচরণ’ ও ‘দুর্নীতিপরায়ণ’-এর অভিযোগে এক বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ-এর দণ্ড দেওয়া হয় তাকে। একইসঙ্গে তার স্থগিত বেতন বৃদ্ধি ভবিষ্যতে বেতন থেকে সমন্বয় করা হবে না মর্মে গত ৩০ অক্টোবর (২০২২) প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।
যশোর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থাকাবস্থায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) সালাহ উদ্দিন শিকদারকে তিরস্কার দণ্ড দিয়ে গত ৩০ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
বরিশাল রেঞ্জ অফিসে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (পুলিশ সুপার) হিসেবে সংযুক্ত কাজী মো. ফজলুল করিম ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিসিপ্লিন শাখায় উপ-কমিশনার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় পিএসআই অলিউল হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে বরখাস্ত) তার কয়েকজন সহযোগীসহ মহাখালী এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটান। এ ঘটনায় তার উদাসীনতা, খামখেয়ালিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, সরকারি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অবহেলার অভিযোগে গত ৩০ অক্টোবর ‘তিরস্কার’ দণ্ড দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত তিন নভেম্বর সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত সংলাপে এই বিষয়ে প্রথম মুখ খোলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যাদের দেশপ্রেম ও দক্ষতার ঘাটতি আছে, তাদের অবসরে পাঠানো হচ্ছে।
এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যাদের চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, ঠিকমতো কাজ করেন না, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যারা কাজ করবেন না, তাদের পদ দখল করে বসে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। সেখানে দক্ষ ও গতিশীল কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ অধিশাখা সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৬১৫টি বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। এরমধ্যে ২ হাজার ৫৪৭টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। এসব মামলায় ৪০১ জন পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত বা বরখাস্ত করা হয়। প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এক হাজার ২০০ পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন দণ্ড দেওয়া হয়।