প্রশান্তি প্রযুক্তি ডেক্স॥ কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে ৮৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের শুরুতে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ ৮৮ শতাংশ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে দুটি জেটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। জেটি দুটিতে বিদেশ থেকে যেকোনো সময় কয়লা নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে। এছাড়া প্রকল্পের বিভিন্ন অবকাঠামোর কাজ শেষ পর্যায়ে। ফলে আগামী ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৬০০ ও জুনে আরও ৬০০ মেগাওয়াট করে মোট ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেশের মূল গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।’
২০১৭ সালের আগস্টে সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিদ্যুৎ বিভাগের উদ্যোগে মাতারবাড়ি মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) কাজটি বাস্তবায়ন করছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ ও গভীর সমুদ্র বন্দরের মোট আয়তন ১ দশমিক ৬৮ একর। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। পরে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা হয়। প্রকল্পে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার ৫০০ জন বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সার্বিক অবকাঠামো নির্মাণের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের তড়িৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু রায়হান সরকার বলেন, ‘১২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। আশা করছি, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ৬০০ ইউনিট এবং একই বছরের জুলাই মাসে দ্বিতীয় ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবো।’
বিদ্যুৎকেন্দ্রের যান্ত্রিক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আগামী বছরের পুরো সময় আমাদের হাতে আছে। এক হাজারের মতো বিদেশিসহ এখানে কাজ করছেন এক হাজার ৪১০ জন। এরই মধ্যে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দুটি ইউনিটে প্রতিদিন ১০ হাজার মেট্রিক টন কয়লা দরকার পড়বে। এই কেন্দ্র পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। মূলত কয়লার জন্য পরিবেশসম্মত উপায়ে কোল্ড ইয়ার্ড স্থাপন করা হয়েছে। বড় ভ্যাসেল থেকে কয়লা নামিয়ে কোল্ড ইয়ার্ডে রাখা হবে। কোল্ড ইয়ার্ড সার্বিকভাবে আচ্ছাদিত অবস্থায় থাকার কারণে ঝড়বৃষ্টিতে কয়লা ছড়িয়ে পরিবেশের কোনও প্রকার ক্ষতি করবে না। সমুদ্রপথে বিদেশ থেকে কয়লা আনা হবে। প্রাথমিকভাবে কয়লা আমদানির জন্য তিনটি দেশকে নির্বাচিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক, অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। আপাতত অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইন্দোনেশিয়াকে কয়লা আনার জন্য বাছাই করা হয়েছে। তাছাড়া এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৮৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পরিবেশের দিকটা খেলাল রেখে কেন্দ্রের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সাগরে কোনও প্রকার বর্জ্য যেতে দেওয়া হবে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন মালামাল আনার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে বন্দর। এই লক্ষ্যে আশপাশের নদী ও সমুদ্র এলাকায় খননের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল নিয়ে এই বন্দরে ১১০টি জাহাজ ভিড়েছে। এখনও একটি জাহাজ পণ্য খালাস করছে।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০২৪ সালের মধ্যে মানসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে সহায়তা করা হবে। প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে, প্রকল্পের আওতায় গভীর চ্যানেল নির্মাণ, কয়লা ও তেল খালাসের জন্য জেটি নির্মাণ এবং কোল ইয়ার্ড ২৭৫ মিটার উচ্চতার চিমনি নির্মাণ, বন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূমি উন্নয়ন। মাতারবাড়ি ও ধলঘাটাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন, অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বাস্তবায়ন এবং টাউনশিপ নির্মাণের কাজ চলছে।
মাতারবাড়িতে বন্দর ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ প্রকল্পের প্রধানতম কাজের মধ্যে অনেক কাজই শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। জমিদাতাদের দেওয়া হয়েছে আধুনিক বাড়ি। ২০১৫ সাল থেকে চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। ৬০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর আরও ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি স্টিম টারবাইন নির্মাণের কাজ চলছে। তাছাড়া সার্কুলেটিং কুলিং ওয়াটার স্টেশন ও পানি শোধনাগার স্থাপন করা হয়েছে। মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার ৪১৪ একর জমিতে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির এই কেন্দ্রে কম পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হবে এবং কম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। ফলে বায়ু দূষণসহ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব একেবারেই কম পড়বে। এছাড়া নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ রোধের জন্য লোরেট বার্নার স্থাপন করা হবে। যেখানে সাব-বিটুমিনাস কয়লা ব্যবহার করা হবে।
এদিকে, মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় স্থানীয়রা বেশ উৎফুল্ল। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র মাতারবাড়িকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করবে। আলো ছড়াবে সারা দেশে। সুবিধা পাবে দেশের মানুষ।
মাতারবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএ ছমি উদ্দিন বলেন, ‘এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে মাতারবাড়িবাসীকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘করোনা মহামারিতেও মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ থেমে থাকেনি। এ কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। ফলে দেশের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’