সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করায় কী লাভ হলো বিএনপির?

বাট্রি॥ একাদশ জাতীয় সংসদ থেকে দলীয় এমপিরা পদত্যাগ করায় বিএনপির নেতাদের মধ্যে এক ধরনের ‘আফসোস’ তৈরি হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে কোনও ‘মোমেন্টাম’ তৈরি না করে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে কোনও ফল না পাওয়ায় এই আফসোস নেতাদের হতাশাকে বাড়িয়ে তুলেছে। বিএনপি ও দলটির সঙ্গে যুগপতে যুক্ত দলগুলোর কয়েক স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, সংসদ থেকে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে কোনও প্রত্যাশা-প্রাপ্তি না হওয়ায় দলে হতাশা এসেছে। কারও কারও ব্যাখ্যা— কোনও ‘মোমেন্টাম’ তৈরি না করে অনেক আগেই পদত্যাগ করায় ফল উল্টো হয়েছে।

গত ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির সমাবেশে সংসদ সদস্য পদ থেকে একে একে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাত সংসদ সদস্য। এই সাত এমপি হলেন— ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হারুনুর রশীদ, বগুড়া-৬ আসনে গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, বগুড়া-৪ আসনে মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আমিনুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জাহিদুর রহমান জাহিদ ও সংরক্ষিত মহিলা আসনে রুমিন ফারহানা।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সংসদে থাকা অবস্থায় বিএনপির এমপিরা যেভাবে ‘ভোকাল’ ছিলেন, দেশে-বিদেশে দলের অবস্থান এবং সরকারের দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করার ‘জাতীয় মঞ্চ’ ছিল, তা এখন বিএনপি ব্যবহার করতে পারছে না। নিয়মিত গণমাধ্যমের কভারেজ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে বিএনপি।

বগুড়া-৬ আসনের উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসা বিএনপি নেতা জিএম সিরাজ বলেন, ‘এতদিন তো আমাদের কয়েকজন সংসদে থাকায় জনগণ আমাদের কথা শুনতো। এখন যারা সংসদে আছেন, তাদের কথা সংসদের চার দেয়াল শুনবে। এখন শোনার লোক নাই।’

দলটির নির্ভরযোগ্য একাধিক নেতা মনে করেন, ‘ভোকাল’ হওয়ার কারণে হারুনুর রশীদ বা রুমিন ফারহানার বিষয়ে ঈর্ষান্বিত মহলটি এক্ষেত্রে একটি অবস্থান তৈরি করেছে। দলের এই অংশটি সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে শীর্ষ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করেছে। একইসঙ্গে জামায়াতের একটি পক্ষও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে বুঝিয়ে সম্মত করেছেন যে, সংসদ থেকে এই সুযোগে দলের এমপিদের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দলের নেতৃত্ব শতভাগ নিশ্চিত করা সহজ হবে।

যদিও রুমিন ফারহানার ব্যাখ্যা ভিন্ন। বুধবার (৪ জানুয়ারি) বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর বিএনপি যে ১০ দফা দাবি দিয়েছে, সেই দফাগুলোর প্রথমেই আছে এই সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এখন নিজেরা সংসদে বসে কীভাবে বলি— সংসদ ভেঙে দিতে হবে? এটা মানানসই নয়। সেজন্য আমরা সরে গেছি। আর আমাদের আন্দোলন আন্দোলনের মতোই চলছে। জেলা, বিভাগীয় পর্যায় শেষে আমরা গণমিছিল করেছি। এখন আমরা ২৭ দফা ও ১০ দফা নিয়ে দেশব্যাপী কাজ করবো।’

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যুক্ত একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা মনে করেন, বিএনপির এমপিদের পদত্যাগ যদি আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে হতো, তাহলে আবেদন ও প্রভাব বেশি হতো। কারণ, পদত্যাগ-ধরনের কর্মসূচি যেকোনও আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে আসে। এরপর সর্বাত্মক কর্মসূচি আসার কথা। কিন্তু পদত্যাগ সময়োচিত হয়নি। তারা পদত্যাগের কার্ডটিকে আরও ভালোভাব ব্যবহার করতে পারতো। খুব ভালো ব্যবহারের সুযোগ বিএনপির সামনে ছিল।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। যে নির্বাচনকে দেশবাসী তামাশা বলছে— সেই সংসদে যাওয়াটা বিএনপির রাজনীতিকে পিছিয়ে দিয়েছিল। একইসঙ্গে মানুষের সামনে সংসদে অংশগ্রহণের যৌক্তিকতাও তুলে ধরা হয়নি সেভাবে। এখন তারা যে পদত্যাগ করেছে, সেটা দেশ, সরকার ও মানুষের সামনে পরিষ্কার মেসেজ  বিএনপির সর্বাত্মক আন্দোলনের। সত্যিকার অর্থে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিএনপির এই বার্তা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’

বিএনপি নেতা জিএম সিরাজ বলেন, ‘২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগের রাতে অন্ধকারে সম্পন্ন হয়ে গেছে। এরপরও দলের সিদ্ধান্তে সাত জন (পরে আমি উপ-নির্বাচনে) সংসদে যোগ দেন। পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তও দলের পক্ষ থেকে হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত ভালোভাবে দেখছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি—আমার সহকর্মীরাও একমত হবেন, বিনাভোটের সংসদে যোগ দেওয়া অসঙ্গতি ছিল। এখন আমরা বলছি, এই বিনাভোটের সংসদ ভেঙে দিতে হবে। আমি মনে করি, এই সিদ্ধান্ত শতভাগ সঠিক। বিএনপিসহ দেশের সব দল এই সরকারের পদত্যাগ চায়। এই সরকারের  যেখানে আমরা বাতিল চাই, সেখানে আমরা এই সংসদে কেমনে থাকি।’

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অবশ্যই সংসদ থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত সঠিক নিয়েছে বিএনপি। আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য— এই সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ। আমরা বরাবরই বলে এসেছি, এই সংসদ অবৈধ সংসদ। আমরা স্ট্রাটেজিক কারণে সংসদে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন মনে করেছি, আর প্রয়োজন নেই, তখনই আমাদের সদস্যরা পদত্যাগ করেছেন। আমরা মনে করি, এমপিদের এই সিদ্ধান্তে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি লাভবান হয়েছে।’ বিএনপির আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, পদত্যাগী এমপিদের মধ্যে উকিল আব্দুস সাত্তার ভিন্ন। তিনি পদত্যাগ করে আবারও উপ-নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দল থেকে বহিষ্কারও হয়েছেন ইতোমধ্যে। ২০১৮ সালে তার মনোনয়নপ্রাপ্তি ও পদত্যাগের পর আসন্ন উপ-নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিয়ে বিএনপিতে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.