পশ্চিমাদের দিয়েই বিএনপিকে চাপে ফেলার কৌশলে আ.লীগ

প্রশান্তি ডেক্স॥ আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে। এমন প্রেক্ষাপটের সুযোগ যাতে বিএনপি নিতে না পারে, সেজন্য পশ্চিমাদের দিয়েই দলটিকে চাপে রাখার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারি দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়েরে অন্তত তিনজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, নির্বাচন এলেই পশ্চিমা দেশগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা বিভিন্নভাবে নানা কথাবার্তা বলার চেষ্টা করে। এর সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে বৈশ্বিক দিক বিবেচনায় আসন্ন নির্বাচন আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় একেবারেই আলাদা। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সেভাবেই কৌশল নির্ধারণ করছে আওয়ামী লীগ।

কী সেই কৌশল জানতে চাইলে নেতারা বলেন, বিএনপি চায় ভোটের আগে বিদেশিদের দিয়ে বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগকে চাপে ফেলতে। সেই তোড়জোড় এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, দৃশ্যমান হতেও শুরু করেছে। থলের বিড়াল খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। পরিস্থিতি বুঝে বিদেশিদের দিয়েই উল্টো বিএনপিকে চাপে ফেলার কৌশল নেওয়া হয়েছে। এটিকে বলা যায়— বিএনপির ছোড়া ঢিল তাদের দিকেই ফিরিয়ে দেওয়া।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, সবশেষ গত বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর গুলশানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত এবং ইইউভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে এই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকেও একই নীতি নেওয়া হয়েছে। আগামীতেও পশ্চিমাদের সঙ্গে বৈঠকেও এই কৌশল নেওয়া হতে পারে।

ইইউর সঙ্গে বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের কৌশল নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ব্রিফিং করেন। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেখানে (বৈঠকে) বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশলের কথা বলেছেন সরকারি দলের নেতারা।’ এমনকি ওবায়দুল কাদেরের ব্রিফিংয়ে উঠে এসেছে— বিএনপি নির্বাচনে যেতে এবং সংলাপে আগ্রহী নয়, তারা ফের সহিংসতার পথে হাঁটতে চাইছে। বিদ্যমান সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, চাপের কাছে আওয়ামী লীগ নতি স্বীকার করবে না। বিএনপির জনসমর্থন নেই, আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। এসব বক্তব্যে বিএনপিকে উল্টো চাপে রাখার কৌশলের ইঙ্গিত রয়েছে।

বৈঠকে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নির্বাচন এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে অর্থপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। আমরা একটা কথা পরিষ্কারভাবে বলেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত (বুধবার) যে কথা বলেছেন, তিনি বলেছেন— আগামী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু, অবাধ হবে এবং নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সরকার তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করবে।’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আর আমাদের বক্তব্য ভিন্ন কিছু নেই। উনি যা বলেছেন, তার প্রতিধ্বনি করেছি। কারণ, আমাদের দল একই ধারণা নিয়ে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’’

বৈঠকে কোনও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরাতো কারও নির্দেশনা শুনবো না। আমাদের নির্দেশনা হলো— দেশের সংবিধান।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, ‘যে দল (বিএনপি) রাষ্ট্রপতির সংলাপকে উপেক্ষা করে, ইসি তাদের দুই বার সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তারা আসেনি। সংলাপের বিষয়ে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, তারা অনাগ্রহী। বিএনপি মনের দিক থেকে নির্বাচনে ইচ্ছুক না। তারা জানে আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসবে। হেরে যাওয়ার ভয়ে এখন তারা কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।’

বিএনপিও গত কয়েক মাস ধরে এভাবে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গিয়ে বৈঠক করে জানিয়েছে— দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। এ বিষয়টি কি আলোচনায় উঠেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, ‘তারা মাঝে মাঝেই আসে। আমরা দেখতে পাই, শুনতে পাই। তারাতো চুপি চুপি আসে। গোপনে গোপনে আসে। জানান না দিয়ে আসে। আমরা কিন্তু কথা বলেই এসেছি, আমাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আমরা এসেছি। সাংবাদিকদের কাছেও বিষয়টি গোপন রাখিনি।’

আওয়ামী লীগের বক্তব্যে ইইউ সন্তুষ্ট কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ফলপ্রসূ ও  অর্থবহ আলোচনা হয়েছে।’ তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছে কিনা সেটা আপনাদেরকে তাদের থেকে জানা দরকার। তারা সবার অংশগ্রহণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। সেখানে  সব দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যে তথ্য পাচ্ছি, তারা (বিএনপি) ২০১৪ ও ১৫ সালের মতো আগুনসন্ত্রাস, সহিংসতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ভর করে সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নির্বাচনে ভয় পেয়ে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করে বিশৃঙ্খলার আবর্তে দেশের ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করছে।’

আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন— আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে তো আমাদের দলের সাধারণ সম্পদক (ওবায়দুল কাদের) ব্রিফ করেছেন, সেখানে বিস্তারিত রয়েছে। তার বাইরে বিশেষ কিছু আর বলার নেই। ওগুলো নিয়েই আলোচনা হয়েছে।’

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাউন্সিলর ডেরেক শোলে ২৪ ঘণ্টার সফরে গত মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশে আসেন। তার নেতৃত্বে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়ায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে তার দল দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি কখনোই ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না। প্রথমবারের মতো সংসদে ইসির পুনর্গঠন আইন পাস হয় এবং তারপর সেই আইনের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। ইসি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং এর প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বাধীনতা রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের অন্যকোনও রাজনৈতিক দলের ভিত্তি নেই। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির জন্ম তো ক্যান্টনমেন্টে হয়েছে।’

ডেরেক শোলের নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে গত বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বৈঠক করে। সেখানে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়নি জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে খুব একটা আলাপ হয়নি। মার্কিন প্রতিনিধি দল নির্বাচন নিয়ে কোনও আলাপ করতে চায়নি। তারা জানে যে, আমাদের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।’

বিএনপি ও জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের প্রমাণাদি মার্কিন প্রতিনিধি দলকে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অগ্নিসন্ত্রাসের কাহিনিগুলো বলেছি, জীবন্ত লোককে দেখিয়েছি যে, দেখেন কীভাবে এই নারী অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। তিনি বাসের ভেতরে ছিলেন এবং সেখানে তাকে মেরে ধ্বংস করে দেয়।’

বৈঠক নিয়ে গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী র‌্যাবের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মার্কিন সমর্থন চেয়েছেন। মার্কিন পক্ষ র‌্যাবের উন্নত কর্মক্ষমতা স্বীকার করেছে। তবে বাহিনীর টেকসই সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। র‌্যাব এখন ওয়াশিংটন কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞার অধীনে রয়েছে। মোমেন বলেন, ‘র‌্যাব আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী এবং বছরের পর বছর ধরে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.