তনিমা রহমান ময়না॥ ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট ছিল শনিবার। সে সময় সাধারণত প্রতি শনিবার আব্বা সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত মো: জিল্লুর রহমান এবং আম্মা আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক প্রয়াত আইভী রহমানের সঙ্গে আমরা তিন ভাইবোন একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেতাম। কিন্তু ঘটনার দিন বিকেলের সমাবেশ নিয়ে আম্মা খুব ব্যস্ত ছিলেন। তাই সেদিন আমাদের দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার কথা ছিল না। তবু আমি দুপুরে আব্বা-আম্মার বাসায় গিয়েছিলাম। গুলশানের আইভী কনকর্ডের বাসার পাঁচতলায় আব্বা-আম্মা থাকতেন আমি থাকি দোতলায়। একই ভবনে থাকার কারণেই সেদিন আম্মার সঙ্গে বসে জীবনে শেষবারের মতো খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু বড় ভাই নাজমুল হাসান পাপন এবং বড় বোন তানিয়া অন্য বাসায় থাকতেন বলে এ সুযোগ তারা পাননি। দুপুরের খাওয়া শেষে একটা মিষ্টির অর্ধেকটা জোর করে আমাকে খাইয়ে বাকিটা আম্মা নিজে খেয়েছিলেন। এরপর সমাবেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কেন যেন পুরো বাসায় একবার চক্কর দিলেন তিনি। পরে একটা প্রশ্ন বহুবার আমার মনে জেগেছে, আম্মা কি বুঝতে পেরেছিলেন সেদিনই তার জীবনের শেষ দিন ছিল! আব্বা-আম্মা একসঙ্গেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন সমাবেশের উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে, তখনও অন্ধকার নেমে আসেনি- আমার ছোট ছেলে এসে আমাকে বলল, ‘মা নানার গায়ে রক্ত’। দৌড়ে গিয়ে দেখি আব্বাকে কয়েকজন মিলে দোতলায় আমার বাসায় নিয়ে এসেছে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কী ঘটে গেছে, সে খবর তখনও জানি না। আব্বার শরীর তখন রক্তে ভেজা। ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না, কিছু শুনতেও পাচ্ছেন না। আমি প্রথমে খুব ভয় পেয়ে গেলেও কিছুটা ধাতস্থ হয়ে শরীর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম, আব্বা কোনো আঘাত পাননি, অন্য কারও রক্ত লেগেছে তার গায়ে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর আব্বা খুব কষ্ট করে জিঞ্জেস করলেন, ‘তোমার আম্মা আসছে’? আমি বললাম না। আব্বা বললেন, ‘তোমার আম্মার খবর নাও’। তখনও আমার মাথায় আসেনি যে, আম্মার কিছু হয়েছে বা হতে পারে। আব্বাকে আমার বাসায় শুইয়ে রেখে আম্মার খোঁজ নিয়ে চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে বড় বোন ফোন করে আমাকে জানালেন, ভাইয়া তাকে ফোন করে বলেছে, সমাবেশস্থলে বোমা হামলা হয়েছে। সম্ববত আম্মা আহত হয়েছেন। তার খোঁজ নিতে ভাইয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেছেন। আমি খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোন দিলাম লিটন চাচাকে। লিটন চাচা সব সময় আব্বা-আম্মার সঙ্গে থাকেন। কিন্তু আম্মাকে নিয়ে তখন ব্যস্ত থাকায় লিটন চাচা ফোন ধরলেন না। ফোন দিলাম ড্রাইভার রফিককে। রফিক ফোন ধরেই কান্নাকাটি শুরু করল। বলল, আপা খালাম্মার তো কিছু নাই। তার গায়ে বোমা লেগেছে। এদিকে ভাইয়া আর ভাবি ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখেন, বারান্দায় ষ্টেচারে আম্মাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বোমায় স্পিল্টারে ক্ষতবিক্ষত তার দুই পা। আম্মার পায়ে একজন ডাক্তার ব্যান্ডেজ করছেন। ততক্ষণে বড় বোনও আমাদের বাসায় চলে এসেছেন। ভাইয়া ফোন করে জানালেন, বোমার আঘাতে আম্মার দুটো পা উড়ে গেছে। তিনি আম্মাকে সিএমএইচে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদেরও যেতে বললেন। আব্বাকে কিছু না জানিয়ে আমরা দুই বোন রাত ৯টা-১০টার দিকে সিএমএইচে গেলাম। তারপর আম্মার অপারেশন শুরু হলো। রাই ২টার দিকে ডাক্তার এসে জানালেন, দুই পা এবং ডান হাত কেটে ফেলা হয়েছে। ষ্পিল্টারের আঘাতে বাম হাতটা কালো হয়ে গেছে। এ ছাড়া কিডনি-লিভারসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ষ্পিল্টার বিদ্ধ হয়েছে। তার জীবন বাঁচানোর জন্য ডাক্তারদের আর কিছুই করার নেই। আমরা তাকে বিদেশে নিয়ে যেতেও চেয়েছিলাম, কিন্তু ডাক্তার বললেন খুব একটা লাভ হবে না।
২২ আগষ্ট ও আম্মার একই অবস্থা। তবে সিএমএইচে সিসিইউতে আম্মার কক্ষে আমাদের তেমন একটা ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। পরে ৫ মিনিট করে একেকজন গিয়ে দেখে আসছিলাম। এমনকি আম্মার মাথার কাছে বসে দোয়া পড়ার অনুমতি চেয়েও পাইনি। পরে আম্মার কক্ষের পাশে যে কক্ষটি আমাদের দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বসেই দোয়া পড়লাম। এমন বাধা দেওয়ার পেছনে সে সরকারের হাত ছিল কি-না জানি না। তবে ২৩ আগষ্ট বিকেলের আগে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যখন আম্মাকে দেখতে সিএমএইচে গেলেন, সেদিন আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের কক্ষের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে রাখা হলো। সে সময় আমি, আমার এক চাচাসহ আত্মীয়স্বজনদের যারাই হাসপাতালে ছিলেন, তাদের সবাইকে প্রায় দুই-আড়াই ঘন্টাা ঐ কক্ষের ভিতরে বন্দি করে রাখা হয়। এমনকি কর্তৃপক্ষের কঠোর নির্দেশ ছিল, প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। তাই আমরা যেন বাইরে বের না হই। প্রধানমন্ত্রী বের হওয়ার পরই কেবল আমরা বের হতে পারব। পরে খালেদা জিয়া চলে যাওয়ার পরই আমাদের বাইরে বের হতে দেওয়া হলো।
২৩ আগষ্ট বিকেলে আম্মাকে দেখতে আব্বা সিএমএইচে যান। সে দিনই রাত ১২টার পর আমাদের ফোন করে জানানো হলো, আম্মা মারা গেছেন। তবে আম্মা আসলে ঠিক কোন সময় মারা গেছেন, সেটি নিয়েও আমাদের সন্দেহ রয়েছে। হতে পারে তিনি ওই দিনই কিংবা আরও আগেই মারা গেছেন। হয়তোবা পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে তার মৃত্যুর খবরটা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। ২৪ আগষ্ট হরতাল ছিল। হতে পারে হরতালের মধ্যে কেউ বের হতে পারবে না। কিছু করা যাবে না। এ কারণেই হয়তো ২৩ আগষ্ট রাত ১২টার পর আম্মার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়। ২৪ আগষ্ট ভোরে আব্বাকে আম্মার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়। ভাইয়া মরদেহ আনতে সিএমএইচে যান। সেখানে গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরিয়ে আম্মার লাশ বাসায় আনা হয়। সেখানে আত্মীয় নেতাকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয় ঘন্টা দুয়েক। তারপর বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। আমার আম্মা সম্পর্কে এক কথায় বলব, তিনি অলরাউন্ডার ছিলেন। দেখতে যেমন সুন্দর ছিলেন, তেমনি সুন্দরভাবে চলাফেরা করতেন। সরকার, রাজনীতি ও সমাজকর্ম সবকিছু সুন্দরভাবেই করতেন। সব শ্রেণীর মানুষ বিশেষ করে মেয়েদের জন্য তার যে ভালোবাসা ছিল, তা পত্রিকায় প্রকাশ করা যাবে না। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, মেয়েদের অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার। রাজনীতি ও সমাজকর্মে ব্যস্ত থেকেও সময় দিয়েছেন সংসারে, ছেলে-মেয়েকে।
২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার ১২ বছর হয়ে গেল। এই ১২ বছর ধরে একটাই চাওয়া পুষে রাখি মনে- এতগুলো মানুষের জীবন যারা কেড়ে নিয়েছে, যাদের জন্য এতগুলো মানুষের সাজানো জীবন তছনছ হয়েছে তাদের যথাযথ শাস্তি হোক। যারা এ ঘটনার মাষ্টারমাইন্ড তাদেরও যেন বিচার হয়। তাহলে আম্মার আত্মা শান্তি পাবে। আম্মাকে হারিয়ে আমাদের পুরো পরিবার যতটা কষ্ট পেয়েছে, রাষ্ট্রপতি হয়েও এই ঘটনার বিচার দেখে যেতে না পারায় তার চেয়েও বেশি কষ্ট ছিল আব্বার মনে। সে সময় তার মধ্যে এক ধরণের আক্ষেপও ছিল, তিনি রাষ্ট্রপতি হলেও তার প্রিয়তমা স্ত্রী আইভী কোনোদিনই বঙ্গভবনে তার সঙ্গে থাকতে পারল না। তিনি সবসময়ই বলতেন, আমি যদি একবার ওকে বঙ্গভবনে নিয়ে আসতে পারতাম, তাহলে আমার রাষ্ট্রপতি হওয়াটা সার্থক হতো। অনুলিখক: অমরেশ রায়; লেখক: তনিমা রহমান ময়না, প্রয়াত আইভী রহমানের ছোট মেয়ে।