প্রশান্তি ডেক্স ॥ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে রায়েরবাজার মহিলা আওয়ামী লীগের বিরাট মিছিলে আসেন নারীরা। প্রতিটি মিছিলের উদ্দেশে ভাষণ দিতে হয়েছিল বলে ভবনের দোতলায় মাইক লাগানো হয়। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ৩২ নম্বর সড়ক ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখর থাকে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বাংলার উপর কোন কিছু চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টা বরদাশত করা হইবে না’। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন।
তিনি বলেন, আগামীকালের মধ্যে সমস্যার কোনও সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ নিজেরা বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনও ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের প্রতি তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বরদাস্ত করা হবে না।
২৪ মার্চ সকাল থেকে অসংখ্য মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসতে শুরু করে। সন্ধ্যার পর পর্যন্ত মিছিল আসা অব্যাহত থাকে। নারী, পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে সমাজের সবশ্রেণির মানুষ এসব মিছিলে শরিক হন। তারা দৃপ্তকণ্ঠে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সঙ্কল্প ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা ে¯্লাগান দেন, ‘সংগ্রাম সংগ্রাম, চলবে চলবে।’
সামরিক শাসকদের উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা যতই ষড়যন্ত্র করুন না কেন, আপনারা জনগণের দাবি ঠেকাতে পারবেন না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দেবো। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না। কোনও শক্তির কাছে মাথা নত করবো না। বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। আমার মাথা কেনার শক্তি কারও নাই। বাংলার মানুষের রক্তের সঙ্গে আমি বেইমানি করতে পারবো না। আমি বুলেটের সম্মুখীন হতে রাজি আছি, কিন্তু জনগণকে গোলাম থাকতে দেবো না।’
এদিন সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। দুই ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তাঁর ঘোষণা দেওয়া। তিনি বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়।
প্রতিরোধ সুসংবদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে নানাবিধ প্রতিরোধের খবর আসছিল। একইসাথে জাতীয় পর্যায়ে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালিত হচ্ছিল। এদিন টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টিভি কর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করে। ফলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা টিভির সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতারা এক বিবৃতিতে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার ব্যাপক জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
ঢাকার বাইরে এদিন রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকসেনারা রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং বহু আহত হয়। এদিকে মিরপুরে অবাঙালিরা সাদাপোশাকধারী পাকসেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালিদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্থানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারিরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে।