বাআ ॥ ৩১ মার্চ রাজধানীর পল্লবীতে ইফতারের দাওয়াতে ডেকে নিয়ে সাংবাদিকদের নির্মমভাবে পিটিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। এর আগে, গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বরেও ধানমন্ডিতে বিএনপির সমাবেশের সময় সাংবাদিকদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় তারা। এসময় টেলিভিশন সাংবাদিকদের ক্যামেরা পর্যন্ত ভেঙ্গে দেয় বিএনপির নেতারা। শত শত বিএনপি নেতাকর্মী প্রকাশ্যে ঘিরে ধরে যেভাবে সাংবাদিক পিটিয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা আর কখনোই ঘটেনি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকার পরেও তারা যেভাবে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, সরকারে গেলে তো গণমাধ্যমের অফিসে গিয়ে গিয়ে পেটাবে তারা।
যদিও সাংবাদিক হত্যা করা বিএনপি-জামায়াত জোটের জন্য নতুন কিছু নয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পাঁচ বছর খালেদা জিয়ার দুঃসহ শাসনামালনে শতাধিক সাংবাদিক নির্যাতনের কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা করেছে বিএনপির নেতারা। এমনকি প্রয় ২০ জন সাংবাদিককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তারেক রহমানের এই পোষ্য ক্যাডাররা।
এখন সেই দলের নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন? মির্জা ফখরুল একদিকে প্রথম আলোর সাংবাদিককে আটকের সমালোচনা করছেন, অন্যদিকে একই দিনে তার নেতৃত্বে এবং তার সামনেই সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে পৈশাচিকভাবে পেটায় তার দলের নেতারা। মানুষ কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ-সংস্কৃতি কর্মীদের ওপর হত্যাযজ্ঞের কথা ভুলে যায়নি।
তারপরেও মির্জা ফখরুল জানতে চান, প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের অপরাধ কোথায়? স্বাধীনতা দিবসে দেশকে বিতর্কিত করার যে অপপ্রয়াস চালিয়েছে প্রথম আলো, সেজন্য সেই সাংবাদিককে আইনের মুখোমুখি হতে হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোটের মতো বর্তমান সরকার হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনে বিশ্বাস করে না জন্যই- আইনকে নিজের পথে চলতে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার পরেও, এই দলের নেতাকর্মীরা আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে কেনো আইনগতভাবে অপসাংবাদিকতাকে মোকাবিলা করছে- এটাই মূলত মির্জা ফখরুলের ক্ষোভ।
বিএনপির স্বৈরাচারী নেতারা যেমন প্রকাশ্যে সাংবাদিক পেটায়, অতীতে তারা যেভাবে তারেক রহমানের প্রশ্রয়ে তারা সাংবাদিক হত্যা করেছে, নির্মম নিপীড়ন চালিয়ে অর্ধশত সাংবাদিককে পংগু করেছে; আওয়ামী একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তা কখনোই করেনি, করবে না। কারণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আইনের শাসনে বিশ্বাস করে।
তারপরেও মির্জা ফখরুলের উস্কানিমূলক প্রশ্নের জবাব হলো- সম্প্রতি বিশেষভাবে আলোচিত প্রথম আলোর সেই বিতর্কিত প্রতিবেদনটি উদ্দেশ্যমূলক এবং যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ওই সাংবাদিক। সাংবাদিকতার শিক্ষা অনুসারে, এই সংবাদটি এক ধরনের ‘এমবেডেড জার্মালিজম’, বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে যার অর্থ হলো ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রস্তুত করা সংবাদ’, সোজা কথায় বললে- কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা এবং অন্য কারো বিরুদ্ধে বিষোদগারের জন্য পরিবেশিত সংবাদ।
স্বাধীনতা দিবসের মতো একটি বিশেষ দিনে দেশব্যাপী স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ সরকারকে টার্গেট করে এবং তাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সংবাদটি বিশেষ এজেন্ডা নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। জনমনে মিডিয়ার প্রভাব সম্পর্কিত গবেষণা থেকে বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা সংবাদের দুটি ধরনের তত্ত্বের বলেছেন। একটি হলো- পাবলিক এজেন্ডা, যার অর্থ যা প্রকৃতপক্ষে ঘটে, তা সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করা। আরেকটি হলো- মিডিয়া এজেন্ডা। যার মানে- নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোনো মিডিয়ার থিংক ট্যাঙ্ক প্রথমে ঠিক করে যে- কোন বিষয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ করা হবে, এরপর তারা সেই সংবাদ যেকোনোভাবেই হোক তৈরি করে দর্শক-স্রোতার সামনে তুলে ধরে এবং সেই তৈরি করা সংবাদের মাধ্যমে গণমানুষের মনোজগত নিয়ন্ত্রণ করে ইস্যু সৃষ্টি করে। এখানে প্রথম আলো সেই এক কাজটিই করেছে।
তারা বিশেষ উদ্দেশ্যে এজেন্ডা সেট করেছে, এরপর সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সংবাদ তৈরি করেছে। যেহেতু তাদের সংবাদের শক্ত ভিত্তি নেই, তাই তারা অবুধ ছোট শিশুকে টাকা দিয়ে ছবি তুলেছে। এমনকি অপ্রাসঙ্গিকভাবে সেই ছবি তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ ও হেডলাইনের সাথে জুড়ে দিয়েছে। ওই সংবাদ-শিরোনামের সাথে ওই শিশুর ছবির কোনো প্রসঙ্গিকতাই নেই। প্রথম আলোর সেই সাংবাদিক, যিনি টাকার বিনিময় ভুলিয়ে-ভালিয়ে অবোধ শিশুর ছবি তুলে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এরপর সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা সেই তথ্যকে রংচং মেখে একটি ফেব্রিকেটেড সংবাদ তৈরি করেছেন। স্বাধীনতা দিবসের মতো একটি বিশেষ দিনে এরকম উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ তৈরি করার পেছনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দেওয়া ছাড়া আর কোনো কারণ নেই। রাষ্ট্রবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রীদের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে মাঠ প্রস্তুতের জন্য এরকম উস্কানিমূলক প্রচারণা নিঃসন্দেহে দেশদ্রোহীতার সমপর্যায়ের অপরাধ।
কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এই দলের নেতাকর্মীরা কখনোই বিএনপি-জামায়াতের মতো আইন নিজের হাতে তুলে নেয়নি, ভবিষ্যতেও নেবে না। বরং দেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে দেশপ্রমিক সচেতন নাগরিক হিসেবে সব ষড়যন্ত্র নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মোকাবিলা করে যাবে। সরকারের সমালোচনা আর রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা এক নয়- বিষয়দুটিকে গুলিয়ে ফেলবেন না। সবার আগে দেশ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন একটি মর্যাদাবান রাষ্ট্র। দেশের সন্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। সব ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতাকে রুখে দাঁড়ান।