মাদক সেবীদের ‘দখলে’ এখন রাজধানীর ফুটপাতগুলো

প্রশান্তি ডেক্স ॥ গত বুধবার (১৪ জুন) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। রাজধানীর কাওরানবাজার জামে মসজিদের পেছনের সড়কের পূর্ব পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে মাদক সেবন করছিল এক যুবক। পাশ দিয়েই আসা-যাওয়া করছিলেন শত শত মানুষ। অথচ কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে মাদকসেবনে মগ্ন সে। বরং পথচারীদের কয়েকজনকে ভয়ে ভয়ে দূরে সরে যেতে দেখা গেছে। শুধু কাওরানবাজারের ওই স্থানটিই নয়, ফার্মগেট হয়ে কাওরান বাজারের ফুটপাত ধরে বাংলামোটর, পরীবাগ হয়ে শাহবাগ যেতে কয়েকটি জায়গাসহ রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাতে এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে হরহামেশাই।

কাওরানবাজার সার্ক ফোয়ারা মোড় থেকে ফার্মগেটের দিকের রাস্তার দুই পাশেই অনেকটা অংশে ফুটপাত বন্ধ করে মেট্রোরেল স্টেশনের কাজ চলছে। এরপর যতটুকু ফুটপাত আছে সেটুকুও মাদকসেবী, ছিনতাইকারী, মানসিক ভারসাম্যহীন লোকজনের দখলে। তারা ফুটপাতে, ওভারব্রিজে শুয়ে বসে থাকে। খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেয়ে পরিবেশ নোংরা করে। বিভিন্ন রকম আবর্জনা ফেলে রাখে। প্রকাশ্যে মাদক নেয়। দুর্গন্ধে নাক ধরে ও ভয়কে সঙ্গে করেই ওই ফুটপাত ধরে পথচারীদের চলাচল করতে হয়।

পরীবাগে ফুট ওভারব্রিজের ওপর প্রায়ই মাদকসেবীদের দেখা যায় প্রকাশ্যেই মাদক নিয়ে রাস্তার ওপর শুয়ে বা বসে থাকতে। অভিযোগ রয়েছে, ফার্মগেটে ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনের ফুট ওভারব্রিজটি দিনে ও রাতের বেশিরভাগ সময় ছিন্নমূল কিশোরদের দখলে থাকে। সেখানে তারা প্রকাশ্যে মাদক সেবন করে, ব্রিজের প্রবেশমুখ বন্ধ করে আড্ডা দেয়, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধ করে বেড়ায়।

কাওরানবাজারে একটি সংবাদমাধ্যম অফিসে কাজ করেন ফাহিমা আক্তার সুমি। ওই এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমি প্রতিদিনই রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার দিকে বাসায় ফেরার জন্য বের হই। সেদিন অফিস শেষে রাত ৯টার দিকে রওনা হয়েছিলাম ফার্মগেট এলাকার তেজতুরীপাড়ার বাসার দিকে। রাস্তা পার হয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। এ সময়  ছিনতাইকারীর কবলে পড়ি। আমার হাতে থাকা ফোন পেছন থেকে টান মারে অল্প বয়সী এক কিশোর। এ সময় আমি পেছনে ঘুরে তাকাই। বুঝতে পেরে ফোনটি শক্ত করে ধরে রাখি। এ সময় ছিনতাইকারী ফোন ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালায়। এরপর থেকে ভয়ে ভয়ে চলি ওই রাস্তায়।

বেসরকারি চ্যানেল এটিএন বাংলার পেছনের একটি ভবনে কাজ করেন খাজা মেহেদী শিকদার। পুরান ঢাকার বাসা থেকে শাহবাগ হয়ে কাওরানবাজারে ওই ফুটপাত ধরে নিয়মিত তিনিও যাতায়াত করেন । তিনি বলেন, এখন তো ফুটপাত নেই। যেটুকু আছে সেটুকুও বিভিন্ন রকম লোকজনের দখলে, নোংরা অবস্থা। দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটতে হয়। এরমধ্যে আছে ছিনতাইকারী-মাদকসেবীদের ভয়।

রাজধানীর শুক্রাবাদে ব্যস্ত ফুটপাতে লোকজনের চলাচলের তোয়াক্কা না করেই শুয়ে থাকতে দেখা যায় এক মাদকসেবীকে, একই পথে প্রতিদিনই যাতায়াত করেন কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী শফিউল ইসলাম। তিনি বলেন, ফুটপাত দখল করে ছিন্নমূল ছেলেমেয়েরা মাদক সেবন করে, এসব তো নতুন কিছু না। কারা দেখবে এসব? প্রশাসন দেখেও দেখে না মনে হয়। না হলে এসব কিশোর ছেলেমেয়ে কীভাবে প্রকাশ্যে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাদক সেবন করে? সন্ধ্যার পর ওই রাস্তা দিয়ে ভয়ে চলাচল করি। যেখানে আলো কম এসব জায়গায় চার পাঁচ জন করে বসে থাকে। এসব পথে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও চলাচল করেন। তারা যে কেউ যেকোনও সময় তাদের দ্বারা উপর্দবের শিকার হতে পারেন।

কাওরানবাজারের ফুটপাতগুলোর এই অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) সারোয়ার আলম বলেন, আমাদের থানা এরিয়ায় ২৪ ঘণ্টাই পুলিশ টহল দেয়। আমরাও মাঠে থাকি। কোনও অনিয়ম দেখলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই। ছিনতাইকারী, মাদকসেবীদের আড্ডা চললেও সেটা হয়তো পুলিশের আড়ালে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখলে তারা কিন্তু আর সেখানে থাকে না। এদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

একই রকম পরিবেশ দেখা যায় হাইকোর্টের পাশে ও জাতীয় ঈদগাহর সামনের ফুটপাতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে কার্জন হলের একপাশ ধরে বঙ্গবাজার যেতে পুরো ফুটপাতে। সেখানে দলবেঁধে তরুণরা দিনের বেলায় মাদকসেবন করে, ফুটপাত দখল করে শুয়ে থাকে, আড্ডা দেয়। গত শনিবার (১৭ জুন) দুপুর ১২টায় শহীদল্লাহ হলের সামনের ওই ফুটওভারব্রিজের ওপরে একপাশে কাপড় টানিয়ে পাঁচ থেকে সাত তরুণকে মাদক সেবন করতে দেখা যায়। ওভারব্রিজের গোড়ায় লোকজনের সামনেই দুই যুবককে মাদক নিতে দেখা গেছে।

রাজধানীর অনেক ফুট ওভারব্রিজেই দিন-রাত বিভিন্ন সময় চোখে পড়বে মাদকসেবীদের শুয়ে-বসে থাকার দৃশ্য, এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট ও মানবাধিকারকর্মী কে এম মাহ্‌ফুজুর রহমান মিশু বলেন, রাজধানীর ফুটপাতে ছিন্নমূল ও ভবঘুরে কিশোরদের আড্ডা, মাদকসেবন করা, নারীদের ডিস্টার্ব করা এটি একটি কমন দৃশ্য। তাদের কাউন্সেলিং করা দরকার। এসব শিশু-কিশোরের মানসিকতার উন্নয়ন প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি প্রয়োজন। অভিযুক্ত শিশু-কিশোরদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে উন্নয়ন কেন্দ্র আছে সেখানে নেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, এনজিও আছে, তারা এসব নিয়ে কাজ করতে পারে। অনেকে করছেও।

রাজধানীতে প্রতিদিনই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় পুলিশ। এরপরও ফুটপাতে,  ফুটওভারব্রিজে রাত-দিনে প্রকাশ্যে দেখা যায় মাদক সেবন করতে। তাদের বিরুদ্ধে  ডিএমপি কী ব্যবস্থা নিচ্ছে জানতে চাইলে  ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন্স) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ডিএমপি মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন অনেকেই প্রতিদিন গ্রেফতারও হচ্ছে। আমাদের এই অভিযান প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তারপরও মাদকমুক্ত দেশ গড়তে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।। নগরবাসীকে নিরাপদ রাখা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভাসমান শিশু-কিশোরদের নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ করে। তাদের এগিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আমরা সবাই যদি মাদকের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, তাহলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

একই প্রসঙ্গ র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা হয়েছে অনেক আগেই। যাদেরই মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে তাদের কোনও ছাড় নেই। মাদক কারবারি, মাদকাসক্ত ও মাদকসেবী এসব লোকজনের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ভাসমান শিশু-কিশোর, লোকজন ফুটপাতে মাদক সেবন করছে এমন অভিযোগ যদি র‍্যাবের কাছে আসে তাহলে র‍্যাব এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.