প্রশান্তি ডেক্স ॥ মানবসম্পদ উন্নয়ন বা দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরিতে নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এরকম উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)’ নামে পৃথক একটি সংস্থাও রয়েছে সরকারের। দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলার নীতি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে এটি গড়ে তোলা হয়। ২০১৯ সাল থেকে কাজ শুরু করে এই সংস্থা। তবে সংস্থাটির কাজ কী, কীভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হয়, কারা এখানে কাজ করেন, তা জানার চেষ্টা করেছে
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার ভিত্তিতে দক্ষতা উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এই সংস্থার মূল লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনায় অভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, সমন্বয়, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮’ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে এনএসডিএ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের আলোকে এ সংক্রান্ত বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর সরকার। বাংলাদেশ বর্তমানে অনুকূল জনমিতিক সুবিধা (তরুণ জনগোষ্ঠী বেশি) ভোগ করছে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত চলবে। প্রতি বছর ২ দশমিক ২ মিলিয়ন কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু এই যুবশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব না হলে এ জনমিতিক সুবিধাকে জনমিতিক লভ্যাংশে রূপান্তর করা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের শ্রমবাজারের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো— বৃহৎ অনানুষ্ঠানিক খাতের উপস্থিতি। মোট শ্রমশক্তির শতকরা ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এই শ্রমজীবী মানুষদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তাই বৃহৎ অনানুষ্ঠানিক খাতের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক স্বল্প শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়ন করে তাদের শ্রমবাজারের উপযোগী করে গড়ে তোলা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এনএসডিএ কাজ শুরু করেছে।
কর্তৃপক্ষের কাঠামো: জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে সরকারের সব দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন ও মূল্যায়ন করতে হবে। এই সংস্থাটির পরিচালনা কমিটির চেয়ারপারসন হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভাইস চেয়ারপারসন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মস্তফা কামাল। পদাধিকার বলে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এনএসডিএ’র কার্যনির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন এবং কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করছেন সচিবের পদমর্যাদার কর্মকর্তা নাসরীন আফরোজ।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদ’ গঠন করে। ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি সরকার সেটি ভেঙে দিয়ে ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে। যা ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৮’-এর অধীনে গঠিত হয়েছিল। পরে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে তা পাস হয়।
বলা হয়েছে, এই কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে থাকবেন সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। কর্তৃপক্ষ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদের সব বাধ্যবাধকতা, চুক্তি এবং দায়বদ্ধতাও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন বিধিমালা-২০২০’-এর আওতায় বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়ন ইকোসিস্টেমের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে এনএসডিএ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করে।
এনএসডিএ-এর তিনটি বডি রয়েছে—কর্তৃপক্ষ, কার্যনির্বাহী কমিটি ও গভর্নিং বোর্ড। গভর্নিং বোডের্র চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব। গভর্নিং র্বোেডর সদস্য ৩০ জন। আর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ১৭ জন।
এনএসডিএ’র কাজ কী : জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) অন্যতম কাজ হলো— ১. জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা, ২. বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/অধিদফতর/সংস্থা এবং বেসরকারি ও এনজিও পর্যায়ে পরিচালিত সব দক্ষতা উন্নয়ন ব্যবস্থাকে সমন্বয় করা, ৩. দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে সব প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা, ৪. খাতভিত্তিক দক্ষতা তথ্যভার প্রতিষ্ঠা করা, ৫. দক্ষতার পূর্ব অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি প্রদান, ৬. প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়ন, সনদায়ন ও পারস্পরিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা, ৭. শিল্প দক্ষতা পরিষদ (ইন্ডাস্ট্রি স্কিলস কাউন্সিল) গঠন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা, ৮. শিল্প সংযুক্তি শক্তিশালী করা, ৯. সব দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করা, ১০. জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার সম্পর্কিত সুপারিশ প্রদান করাসহ দক্ষতার প্রচার প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক যুব সমাজকে দক্ষতা উন্নয়ন বা প্রশিক্ষণে আগ্রহী করে তোলা।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ৩১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভর্নিং বোডের্র প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় জাতীয় ‘দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০২১’ এবং ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা ২০২২-২০২৭’ অনুমোদন করা হয়। এছাড়া, দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত বাংলাদেশ জাতীয় যোগ্যতা কাঠামো (বিএনকিউএফ)-এর ১ থেকে ৬ স্তরের কোর্স এবং দক্ষতা সম্পর্কিত শর্ট কোর্স (সর্বোচ্চ ৩৬০ ঘণ্টা) পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের দায়িত্ব, অকুপেশনভিত্তিক সনদায়নের কোর্স বা ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিতকরণ, জাতীয় যোগ্যতা কাঠামোর আওতায় ১ থেকে ৬ স্তরের দক্ষতা প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোর কম্পিটেন্সি স্ট্যান্ডার্ড ও কারিকুলাম প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন-পরিবীক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে ট্রেইনার, অ্যাসেসর, প্রশিক্ষণার্থী অ্যাসেসমেন্ট ও সনদায়ন এবং আরপিএল-এর মাধ্যমে সনদায়ন প্রক্রিয়া এনএসডিএ সম্পন্ন করবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আরও যেসব কাজ হবে : জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এরইমধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ৩১৯টি দক্ষতা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিবন্ধিত হয়েছে। এনএসডিএ এখন পর্যন্ত ১৬৩টি কম্পিটেন্সি স্ট্যান্ডার্ড, ১৬৩টি কোর্স অ্যাক্রিডিটেশন ডকুমেন্ট, ২৮টি কারিকুলাম, ১৬টি কম্পিটেন্সি বেজড লার্নিং ম্যাটেরিয়াল প্রণয়ন করেছে। বর্তমানে এসব কার্যক্রমসহ প্রশিক্ষণার্থীদের অ্যাসেসমেন্ট করার লক্ষ্যে অ্যাসেসমেন্ট পুল গঠনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমানে এনএসডিএ’র আওতাভুক্ত ৪৬টি অ্যাসেসমেন্ট সেন্টার রয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পেশাভিত্তিক ৩১৯ জন অ্যাসেসর এবং ১৭৯ জন প্রশিক্ষক কাম অ্যাসেসর নির্বাচন করা হয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৭০৮ জন প্রশিক্ষণার্থীকে বিভিন্ন অকুপেশন ও লেভেল এ যোগ্য বিবেচনা করে সনদায়ন করা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ন্যাশনাল স্কিলস পোর্টাল তৈরি করেছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা এনএসডিএ। কর্মসংস্থানের চাহিদা ও জোগানের রিয়েল টাইম ডাটা, গ্র্যাজুয়েট ট্র্যাকিংসহ অনলাইন নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ মূল্যায়ন, প্রশিক্ষণার্থীদের অ্যাসেসমেন্ট ও সনদায়নের সুযোগসহ মোট ১৬টি মডিউল সংবলিত ন্যাশনাল স্কিলস পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে।
পোর্টালে নিবন্ধন ও সনদায়ন থেকে সব প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের একটি সমন্বিত ডাটাবেজে শিল্প সংগঠনগুলোর অন্তর্ভুক্তি থাকবে। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠান তার প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি পোর্টালের মাধ্যমে সংগ্রহ করে নিতে পারবে। পোর্টালটির মাধ্যমে দক্ষতা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং স্বয়ংক্রিয় প্রতিবেদন প্রস্তুত করা সম্ভব হবে। পোর্টালটিতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, আইবাস, বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়ে এবং গুগল ম্যাপসহ বিভিন্ন কানেক্টিভিটি থাকবে। বিটিসিএল থেকে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ডোমেইন কেনা হয়েছে এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ন্যাশনাল ডাটা সেন্টারে হোস্টিং করা হয়েছে। ন্যাশনাল স্কিলস পোর্টালের প্রথম মডিউল স্কিলস ট্রেনিং প্রোপ্রাইডার রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে পোর্টালটি লাইভ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এনএসডিএ স্বীকৃতি পেয়েছে। জানা গেছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড স্কিলস ইন্টারন্যাশনাল এবং ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড স্কিলস এশিয়া’র সদস্যপদ লাভ করেছে। রাশিয়ার কাজানে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ৪৫তম বিশ্ব দক্ষতা প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পেস্ট্রি অ্যান্ড কনফেকশনারি এবং ফ্যাশন টেকনোলজি দুটি অকুপেশনে অংশগ্রহণ করেছে। ওয়ার্ল্ড স্কিলস কম্পিটিশন সুইজারল্যান্ড-২০২২-এ বেকারি ট্রেডে অষ্টম, ফ্যাশন টেকনোলজিতে ১৮তম এবং কুকিং ট্রেডে ২৯তম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশি প্রতিযোগীরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারপারসন (সচিব) নাসরীন আফরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংস্থাটি নতুন বলেই চ্যালেঞ্জ অনেক। তবে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা এনএসডিএ দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত আয়ের দেশে পৌঁছানোর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’