প্রশাান্তি ডেক্স॥ বাংলাদেশে প্রতি ৯৪ হাজার ৪৪৪ জন মানুষের বিপরীতে বিচারক রয়েছেন মাত্র একজন। অপরদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি ৪৭ হাজার ৬১৯ জন এবং পাকিস্থানে প্রতি ৫০ হাজার মানুষের বিপরীতে একজন বিচারক রয়েছেন। গত ১৫ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে বিচারাধীন মামলার জট দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের আদালতগুলোতে এই মুহূর্তে ৪২ লাখের মতো মামলা ঝুলছে।
আইন কমিশনের এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও মামলার জট কমানোর সুপারিশসহ আইন কমিশন এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার জন্য বিচারক সংকটসহ বেশ কিছু কারণ তুলে ধরে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার (২৯ আগস্ট) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনে মামলা জটের প্রধান কারণ হিসেবে বিচারকের স্বল্পতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈঠকে আইন কমিশনের বক্তব্য নেওয়া হলেও কমিটি এটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেনি। পরবর্তী বৈঠকে তারা প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনা করে সরকারকে সুপারিশ করবে।
প্রতিবেদনে দেশের জনসংখ্যার সঙ্গে বিচারকের সংখ্যা তুলনা করে বলা হয় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এই সংখ্যাকে বর্তমানে বাংলাদেশের জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে বিদ্যমান বিচারকের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে দেখা যায় যে বাংলাদেশে ৯৪ হাজার ৪৪৪ জনের বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা মাত্র একজন, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নিতান্তই কম। যুক্তরাজ্যে আনুমানিক বিচারকপ্রতি জনসংখ্যা ৩ হাজার ১৮৬ জন। যুক্তরাষ্ট্রে এটি ১০ হাজার, ভারতে বিচারকপ্রতি জনগণ ৪৭ হাজার ৬১৯ এবং পাকিস্থানে প্রায় ৫০ হাজার।
নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে থাকবে বলে ঘোষণা দিলেও কার্যক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সোনার হরিণ হয়েই থাকে। এই বিভাগ কোনও সময়ই সরকারের কাছ থেকে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ৬ হাজার ৮৯২টি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাড়ায় ১৯ হাজার ৯২৮। হাইকোর্ট বিভাগে ২০০৮ সালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯০১টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৪। জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতগুলোতে ২০০৮ সালে মামলা ছিল ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১২১টি। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিচারাধীন মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ১টিতে। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে উচ্চ আদালতসহ দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি। ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৪টি।
২০০৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ফি বছর মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। গত ১৫ বছরে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এই অস্বাভাবিক মামলাজট নিরসনের ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বিচার ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের শুধু আস্থাই হারিয়ে যাবে না বরং বিচার ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়বার উপক্রম হবে।
বিচারক স্বল্পতাকে মামলাজট বা মামলার দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাতে বলা হয়, এই বিপুল সংখ্যক মামলা পরিচালনার করার জন্য বিচারকের সংখ্যা অতিনগণ্য। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা ৮ জন এবং হাইকোর্টে বিচারপতির সংখ্যা ৯০ জন। এই তথ্য অনুযায়ী, আপিল বিভাগে বিচারের জন্য বিচারক প্রতি মামলা রয়েছে ২ হাজার ৪৯১টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক প্রতি মামলা রয়েছে ৫৭৪১টি। অপরদিকে, জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে বর্তমানে বিচারকের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এর মধ্যে ডেপুটেশনে রয়েছেন আনুমানিক ২০০ জন বিচারক। সেই হিসেবে জেলা বিচার বিভাগে বিচারক প্রতি মামলা আছে ২ হাজার ৩৩টি।
উল্লেখ্য, দেশের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে আদালতের সংখ্যার বিপরীতে কমসংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়ার কারণে অনেক আদালত ভারপ্রাপ্ত বিচারকদের দিয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। ফলে একজন বিচারককে তার নিজস্ব আদালতের মামলার অতিরিক্ত মামলার বিচারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। যার কারণে বিচারকরা অনেক সময়ই যথাযথ মনঃসংযোগ প্রদান করতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয় এবং ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়।
তাছাড়া যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ ও জেলা জজরা দেওয়ানি আপিল-রিভিশন, ফৌজদারি আপিল-রিভিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন বিচারককে বিভিন্ন প্রকারের একাধিক আদালতের মামলার বিচারকার্যে নিয়োজিত থাকতে হয়। একই বিচারকের উপরে একাধিক আদালতের দায়িত্বভার আরোপিত থাকার কারণে অনেক সময়ই কোনও একটি আদালতের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী বা শুনানি শুরু হলে অপর আদালত/ট্রাইব্যুনালগুলোর মামলা পরিচালনা করা সম্ভবপর হয় না। কিছু আদালতের বিচারকের এত বেশি মামলার থাকে যে তিনি যদি শুধু স্বাক্ষরও করেন তাতেও অনেক সময় ব্যয় হয়। ফলে কজলিস্টে থাকা প্রতিদিনের সকল মামলা শুনানি করা প্রায়শই সম্ভব হয় না। এতে করে বিচারপ্রার্থী জনগণকে হয়রানির শিকার হতে হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলার জট কমাতে অতিদ্রুত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিচারক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে পদ সৃষ্টি করে কমপক্ষে ৫ হাজার বিচারক নিয়োগ করা হলে বর্তমান মামলার জট কমিয়ে মামলার সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হবে।
অন্তবর্তী সমাধান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচার বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের, জেলা জজদের মধ্য হতে দক্ষ, সৎ, যোগ্য কর্মকর্তাদেরকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পদায়ন করলে পুরাতন বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার শুনানি, আপিল ও রিভিশন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, আইন কমিশন একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান এটা নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। কিছু বাস্তবধর্মী পরামর্শ এসেছে। আমরা প্রতিবেদন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ পাইনি। পরবর্তী বৈঠকে এটা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করে কমিটির পক্ষ থেকে একটি সুপারিশমালা তৈরি করে সরকারকে পাঠাবো। যাতে বিচারজট কমানোসহ মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেবো।