এমটিএফই প্রতারণা:…?!

প্রশান্তি ডেক্স॥ এমটিএফই আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে ট্রেডিংয়ের সুযোগের নামে পরিচালিত একটি অনলাইন পঞ্জি স্কিম অ্যাপ। মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ নামে একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি (বিট কয়েন) ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম এটি। প্রতারকচক্র কিছু কমিশনের লোভ দেখিয়ে আর মিষ্টি কথা বলে এমটিএফই’তে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলে সাধারণ মানুষকে। আর এই প্রতারকদের ফাঁদে পড়েন বাংলাদেশের লাখ লাখ নারী-পুরুষ। অল্প সময়ে বিত্তশালী হওয়ার আশায় লোকজন হাজার থেকে লাখ লাখ টাকা অনলাইনে অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে ওই প্রতিষ্ঠানটিতে। সাম্প্রতিক সময়ে এসব গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় এমটিএফই কর্মকর্তারা। এ ঘটনা পর থেকে দেশে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ইস্যুটি। প্রতারিত হয়ে লাখ লাখ টাকা হারিয়ে এ বিষয়ে অনেকে এখন মুখ খুলছেন। আবার কেউ কেউ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করছেন বিভিন্ন থানায়। তবে এর আগেও দেশে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) নামে কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসা ছড়িয়ে লোকজনকে ঠকিয়েছে। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে পথে বসিয়েছে হাজার হাজার গ্রাহকদের, তারপরও সচেতন হচ্ছে না এসব লোকজন। সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এসব তথ্য আগে জানতে পারেনি। এমটিএফই  প্রতারণা নিয়ে ভুক্তভোগীর অভিযোগের আগে বিষয়টি নজরেই আসেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির।

এমটিএফই নিজেদের কানাডিয়ান কোম্পানি দাবি করে। এটি ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে কোম্পানিটি বাংলাদেশে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করে।

বিষয়টি সামনে আসার পর প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চেয়েছে সিআইডি। বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে একাধিক ভুক্তভোগী তাদের কাছে অভিযোগ করেছেন।

সিআইডি জানিয়েছে, গত ২৮ আগস্ট রাতে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন এমটিএফইয়ে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়া ভুক্তভোগী মারুফ রহমান ফাহিম। ওই মামলার এজাহারে প্রধান আসামি করা হয় কুমিল্লার মুরাদনগরের সাতপুরা গ্রামের মাসুদ আল ইসলামকে।

এজাহারে বলা হয়, মাসুদ নিজেকে এমটিএফই’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান দাবি করেছিলেন। মামলায় দুই নম্বর আসামি দক্ষিণ খিলগাঁওয়ের মুবাশসিরুল ইবাদ। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ইবাদ মামলার বাদীর মায়ের বান্ধবীর স্বামী। তারা পূর্বপরিচিত ও একই এলাকায় বসবাস করেন। বাদী তাকে আঙ্কেল বলে ডাকেন। মাস ছয়েক আগে ইবাদের কাছ থেকে এমটিএফই সম্পর্কে জানতে পারেন বাদী। ইবাদ তাকে জানান, ওই অ্যাপে দিনে ২০১ ডলার বিনিয়োগ করলে ২৪ ঘণ্টায় ৫ ডলার লাভ দেওয়া হয়। এমন প্রলোভনে বাদীর মা রোকেয়া পারভীন রুনার নামে এমটিএফইতে হিসাব খোলেন বাদী। বাদীর বাবা ও ভাইয়ের নামেও হিসাব খোলা হয়। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে তারা প্রায় ১০ লাখ টাকা হারিয়েছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করেন।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এসব অ্যাপ ব্যবহার করে দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য কোনও দেশে অর্থ পাঠানো নিষেধ। আর যদি পাঠায় তাহলে এটি অপরাধ। এছাড়াও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। যার কারণে প্রতারিত গ্রাহকরা আইনের দ্বারস্থ হতে ভয় পাচ্ছেন। আর সিআইডি বলছে, সংস্থাটি এসব মামলার তদন্ত শুরু করেছে। জড়িতদের গ্রেফতার করতে ফাহিমের মামলার সূত্র ধরেই সংস্থাটি তদন্ত করছে।

অ্যাপে যারা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এবং লেনদেন করেছেন তাদের ফুটপ্রিন্ট অনলাইনে রয়েছে। এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান (জোহা) বলেন, অনলাইনে এসব অ্যাপ ব্যবহার করে ভৌগোলিকভাবে দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য কোনও দেশে অর্থ পাঠানো নিষেধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে। যেহেতু এভাবে ব্যবসা করা বৈধ নয় তাহলে আগেই কেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি প্রশ্নের জবাবে সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান আরও বলেন, কোনও অভিযোগ ছাড়া আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ব্যবস্থা নেবে না। হয়তো আগে কোনও অভিযোগ পায়নি এজন্য ব্যবস্থা নেয়নি। এছাড়াও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। যার কারণে প্রতারিত গ্রাহকরা আইনের দ্বারস্থ হতে ভয় পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, এমটিএফইতে অ্যাকাউন্ট খোলার পর বিন্যান্স নামে যে অ্যাপস ছিল সেটিতে অফিসিয়ালি সবকিছু রয়েছে। সেখানে কারা জড়িত এবং কারা কত টাকা ইনভেস্ট করেছে তাও রয়েছে। বিন্যান্স অ্যাপসের কোনও তথ্য জানতে হলে তাদের কাছে সহায়তা চাইতে হবে। অ্যাপসের তথ্যগুলো নিতে হলে মামলা রুজু করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে এই তথ্য চাওয়া যেতে পারে এবং কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম (সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন) বলেন, এমটিএফই’র মতো এমন অ্যাপ দেশে আরও রয়েছে। এসব অ্যাপে অনেকে বিভিন্ন কাজ করছেন। আসলে কোনটি দিয়ে এমন লেনদেন করছে এ বিষয়ে কেউ যদি অভিযোগ না করে তাহলে শনাক্ত করা কঠিন। তারপরও এসব অ্যাপের বিষয়ে প্রতিনিয়ত নজরদারি করছে সিআইডি। এমটিএফই নিয়ে এর আগে কেউ অভিযোগ না করায় এটি আমাদের নজরে আসেনি। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যারা কাজ করছেন বা ফাঁদে পড়ে বিনিয়োগ করেছেন তারাও জানতো প্রক্রিয়াটি বৈধ নয়। বিভিন্ন পেশার লোকজন বিনিয়োগ করেছেন। কোথায় কেউ আমাদের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেনি। বিষয়টি নিয়ে গ্রাহকরাও নীরব ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, এমটিএফই প্রতারণা নিয়ে মারুফ রহমান ফাহিম নামে একজন ভুক্তভোগী সিআইডির কাছে অভিযোগ করেছেন। ইতোমধ্যে ওই ব্যক্তি রাজধানীর খিলগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেছেন। তার মামলা সূত্র ধরেই আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। কারা কারা জড়িত তাদেরকে খোঁজে বের করে গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা চলমান রয়েছে।

অ্যাপে যারা অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এবং লেনদেন করেছেন তাদের ফুটপ্রিন্ট অনলাইনে রয়েছে। এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে যেভাবে এমটিএফই উধাও হয়: একাধিক ভুক্তভোগী থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ আগস্ট থেকে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখিয়ে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে দেয় এমটিএফই। এরপরে গ্রাহকদের সঙ্গে কাস্টমার সার্ভিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কোম্পানিটি। পরে কাস্টমার সার্ভিস থেকে জানানো হয় সফটওয়্যার আপগ্রেডের কারণে আপাতত উত্তোলন সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। একটি নোটিশ দিয়ে এ তথ্য জানানো হয়। তবে এরপরে ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও তাদের সফটওয়্যার আপগ্রেড শেষ হয়নি। উল্টো ৭ তারিখের আগে গ্রাহকদের উইথড্রো দেওয়া সব ডলার রিজেক্ট করে পুনরায় অ্যাকাউন্টে ফেরত নিয়ে যায়।

আবার নোটিশ দিয়ে জানানো হয়, সফটওয়্যার আপগ্রেডের কাজ নির্বিঘ্নে করতে সকলের লেনদেন বাতিল করা হয়েছে। তবে গত ১৭ তারিখে এমটিএফই তাদের অ্যাপে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও গ্রাহকরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বাটন অন করতে পারেনি। পরে ওইদিন রাত ৮টার পরে কোম্পানিটি গ্রাহকদের অনুমতি ছাড়াই এআই বাটন অন করে দেয়। এদিন রাত ১২টার পরে ট্রেডিংয়ের নামে সকলের অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেওয়া হয়। উল্টো গ্রাহকদের মূলধনের অর্থের সমপরিমাণ ডলার মাইনাস করে দেখানো হয়। এবং তাদের অ্যাপে জরুরি নোটিশ জারি করা হয়।

নোটিশে বলা হয়, গ্রাহকরা এমটিএফই সেবা চলমান রাখতে হলে তাদের মাইনাস ব্যালেন্স পরিশোধ করে আবার ডলার ডিপোজিট করুন। এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এমটিএফই’র প্রাপ্ত মাইনাস ডলার পরিশোধ না করলে গ্রাহকদের আইনি নোটিশ পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। শুধু বাংলাদেশই নয় এমটিএফই তাদের কার্যক্রম পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, ইসরাইল, উজবেকিস্থান, কাজাকিস্থান, কেনিয়া, তানজানিয়া, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ওমান, আইভরিকোস্ট, ইরাক, ইয়েমেন ও জিবুতিতে তারা প্রতারণা করে প্রায় ৭ কোটি মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার নিয়ে উধাও হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.