প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানুষের মঙ্গলের জন্য ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন ২৯টি দেশ জাতিসংঘ সনদে অনুস্বাক্ষর করে। এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক সমস্যা সমাধানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহায়তা বৃদ্ধি করা। এর প্রধান তিনটি ক্ষেত্র হচ্ছে শান্তি ও নিরাপত্তা, টেকসই উন্নয়ন এবং মানবাধিকার ও মানবিক সহায়তা। টেকসই উন্নয়নে কিছুটা অবদান রাখতে পারলেও শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষায় ক্রমাগত হোঁচট খেয়েই চলেছে জাতিসংঘ। যেখানে জাতিসংঘ সব দেশের জন্য সর্বজনীন সংস্থা হওয়ার কথা ছিলে, সেখানে পঞ্চশক্তির (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স ও রাশিয়া) হাতে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার মো. শহীদুল হক বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে ক্রমাগত হোঁচট খাচ্ছে জাতিসংঘ। বর্তমানে সংস্থাটির অবস্থা দেখে মনে হয়, এর ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।’ জেনেভাতে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মো. আব্দুল হান্নান বলেন, ‘যেকোনও ধরনের যুদ্ধ থামানোর ম্যান্ডেট জাতিসংঘের আছে। কিন্তু বৃহৎ পাঁচটি শক্তির ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে জাতিসংঘ ওই ভূমিকা রাখতে পারছে না।’
তিন ক্ষেত্র: প্রথম থেকে জাতিসংঘ শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের কোনও ভূমিকা রক্ষা করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেক দেশে অনেক অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে এবং সেগুলোর সমাধানে কার্যত কোনও ধরনের ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। বর্তমানে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বা রোহিঙ্গা গণহত্যার সময়েও কোনও কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি সংস্থাটি।
এ বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের ভূ-রাজনৈতিক রসায়ন ও যুদ্ধ- বিগ্রহ বন্ধে জাতিসংঘের ভূমিকাকে খাটো করে রেখেছে পাঁচটি শক্তিশালী দেশ। ওই পাঁচ সদস্যের অনুমোদন ব্যতীত জাতিসংঘ বড় কোনও ভূমিকা রাখতে পারে না।’
টেকসই উন্নয়নে জাতিসংঘ কিছুটা হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এমডিজি ও এসডিজি প্রণয়ন ও পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিসেবে বড় ভূমিকা রাখছে জাতিসংঘ। সামাজিক উন্নয়ন কাঠামো তৈরি করার মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে একটি উন্নয়ন রোডম্যাপ দিতে পেরেছে।’
মানবাধিকার ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতা আছে। যখন কোনও সমস্যা তৈরি হয়, তখন তাদের কার্যক্রম শুধুমাত্র কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে বলে জানান সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ মানবাধিকার ও মানবিক সহায়তা ঠিকমতো দিতে পারছে না বলে মালি থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন সমস্যাসঙ্কুল স্থানে মানবিক সহায়তা দেওয়া যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে আব্দুল হান্নান বলেন, ‘যুদ্ধ থামানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন না করলেও সাধারণভাবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে মোটামুটি ভালো কাজ করছে জাতিসংঘ। তাদের কারণে সমস্যাপ্রবণ দেশে প্রাণহানির আশঙ্কা অনেক কমে গেছে।’
জাতিসংঘে সংস্কার : কার্যকর জাতিসংঘের জন্য বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন এবং সেজন্য সবার সদিচ্ছা দরকার। শহীদুল হক বলেন, ‘জাতিসংঘের ব্যাপ্তি বড় করে এটিকে কার্যকর করা যাবে না। আমার মতে, জাতিসংঘের কার্যক্রম ছোট হোক, কিন্তু সেটি যেন কার্যকরী হয়।’
তবে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ যদি না থাকতো, তবে আমাদের নতুন একটি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা করতে হতো। সেজন্য জাতিসংঘকে একদম ফেলে দেওয়া যাবে না।’
জানতে চাইলে আব্দুল হান্নান বলেন, ‘সংস্কারের দাবি এখন অনেক বেশি জোরালো হচ্ছে। গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন এ বিষয়ে অনেক বেশি সোচ্চার এবং তাদের মধ্যে একটি ঐকমত্য আছে। ওই সংস্কার যত তাড়াতাড়ি হবে, গোটা বিশ্বের জন্য তত বেশি মঙ্গল হবে।’