ভজন শংকর আচার্য্য, কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি ॥শীত মৌসুম শুরুতে গ্রাম বাংলার পাড়া-গাঁয়ে খেজুর গাছ থেকে সুস্বাদু রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হতেন গাছীরা (গাছ পরিচর্যাকারীরা)। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুর রসের সঙ্গে সম্পৃক্ত পেশা ‘গাছি’। আর এ পেশায় গাছিদের সংখ্যাও কমে গেছে। ফলে কিছু গাছ টিকে থাকলেও পরিচর্যার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রসের সঙ্গে হারাতে বসেছে খেজুর গাছ সম্পৃক্ত পেশা-গাছি। একপ্রকার মানুষ ভুলতে বসেছে খেজুর গাছের রসের স্বাদ। এক সময়ে শীত মৌসুমের শুরুতেই ভোরের কুয়াশা অতিক্রম করে গ্রামগঞ্জের গাছিরা কাছি (মোটা দড়ি), বেতের ঝুড়ি কোমরে বেঁধে ছুটে চলতেন গ্রামের মেঠ পথ ধরে। ঝুড়ির ভেতরে থাকত কয়েক রকমের গাছ কাটা দা, বালি রাখার চুঙ্গা, রসের হাঁড়ি বা ঠিলা এমনকি দায়ে ধার দেয়ার বিভিন্ন প্রকারের সরঞ্জাম।
শীতের শুরুতেই গাছ পরিচর্যা (গাছ কাটা) নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন গাছিরা। গাছের উপরে উঠে নিজেকে কোমরের কাছিতে বেঁধে তারপর চলত গাছ পরিচর্যা। কে কার আগে খেজুর গাছ কেটে রস নিয়ে বিক্রি করতে পারবে এর প্রতিযোগিতা চলত। খেজুর রসে তৈরি নানা প্রকার পিঠা-পায়েশ ছিল মানুষের নবান্নের সেরা উপহার। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার অত্যন্ত জন প্রিয় শীত কালীন ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস। এমন একসময় ছিল গোটা শীত মৌসুমজুড়ে রসের পিঠা, পায়েস, গুড় তৈরি হত ঘরে ঘরে। শীত আসার সাথে সাথে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ত গাছীরা। সময়ের সাথে সাথে একদিকে যেমন খেজুর গাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে, অন্যদিকে অভিজ্ঞদের অভাবে গাছী তৈরী হচ্ছে না। বর্তমানে খেজুর রসের চাহিদা অনেক বেশি। ১৫লিটারের প্রতি কলস সাড়ে ৭ থেকে ৯’শ টাকায় এবং প্রতি কেজি গুড় ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাস্তার পাশে, জমির আইল, পরিত্যাক্ত জমিতে বিনা পরিচর্যায় যে কোন ধরনের মাটিতে এ প্রজাতির গাছ ভালো জন্মায়। কসবা উপজেলা কৃষি অফিস, কৃষকদের উচ্চ ফলনশীল আরব জাতের পাশাপাশি দেশীয় খেজুর গাছ রোপণ করার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এতে রস ও গুড়ের চাহিদা পূরণ ছাড়াও খেজুর রস বিক্রি করে আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়া যায়। অপরদিকে খেজুর গাছের পাতা দিয়ে পাটিসহ বিভিন্ন কুটির শিল্পের কাজ করা ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আগের মতো গ্রামের রাস্তার দু’পাশে সারি সারি খেজুর গাছ আর নেই। গ্রামের রাস্তাগুলো সংস্কার ও নতুন করে খেজুর গাছ রোপনে মানুষের আগ্রহের অভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও খেজুরের রস ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনও গ্রামে দু’একটি বাড়ির উঠানের আশপাশে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু খেজুর গাছ। কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাট-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। আবার কেউ কেউ সকালে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করতো। প্রতিবছর শীত মৌসুমে অযত্নে অবহেলায় পথে প্রান্তরে পড়ে থাকা খেজুর গাছের রস ও গুড় বিক্রি করে এ সময়ে বাড়তি আয় করতো। গ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি জানান, কয়েক বছর আগেও শীত মৌসুমে খেজুর রসের তৈরি নানা প্রকার পিঠা-পায়েসসহ সুস্বাদু নবান্নের খাবার দিয়ে উৎসাহ ও আনন্দের মধ্যে আমরা নবান্নকে বরণ করতাম। এখন আর খেজুর রস না পাওয়ায় নবান্নের আনন্দ থেকে বঞ্চিত। শীত মৌসুমে অতিথিদের রসের তৈরি পায়েশ দিয়ে আপ্যায়ণ করানোর প্রচলন এখন ভুলতেই বসেছেন গ্রামাঞ্চলের মানুষ। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছের রস রূপ কথার কাহানী হয়েছে। কয়েকজন গাছি জানান, পরিচর্যার অভাবে খেজুর গাছ মারা যাচ্ছে। আর যে হারে নিধন হচ্ছে তাতে একসময় হয়তো খেজুর গাছ দেখাই যাবে না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কারণ নতুন করে খেজুর গাছ রোপনে মানুষ আগ্রহী হচ্ছে না। তালগাছ রোপনের মত খেজুর গাছ রোপনে সরকারী-বেসরকারী প্রচারণা থাকলে খেজুর গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারত। না হলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুর গাছের রস, হারিয়ে যাবে গ্রাম বাংলার আরো একটি ঐতিহ্য। কসবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুর গাছের রস, শীত মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে রস সংগ্রহের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকেন গাছিরা। গাছিদের খেজুর গাছ পরিচর্যার কাজটি এক ধরনের শিল্প। এর জন্য দরকার হয় বিশেষ দক্ষতা। ডাল কেটে গাছের শুভ্র বুক বের করার মধ্যে রয়েছে কৌঁশল, রয়েছে ধৈর্য। খেজুরের রস থেকে বিভিন্ন রকমের গুড় তৈরি করে থাকেন গাছিরা। দিন দিন এই শিল্প বিলুপ্তির পথে।