১৬ই ডিসেম্বর: মহান বিজয় দিবস-নিশঙ্ক চিত্ত, সুউচ্চ শির

বাআ ॥ ১৬ ডিসেম্বর, রক্তস্নাত বিজয়ের ৫২তম বার্ষিকী। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাথা উচু করার দিন। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বহু প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদিনে বীর বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সূর্য। পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী এদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের পর এদিন আত্মসমর্পণ করে মুক্তিকামী মানুষের কাছে। আর পাকিস্থানি বাহিনীর এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্থানি শোষণ আর বঞ্চনার। নির্যাতন, নিষ্পেষণের কবল থেকে মুক্ত হয় বাঙালি জাতি।

৪৯ বছরের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার বিশ্লেষণ হচ্ছে সর্বত্র। বিজয়ের ৪৯ বছর পূর্তিতে আজ মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মা পেয়েছে শান্তি- ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের অনেকের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আজ পরম শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় পুরো জাতি স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী লাখো শহীদদের। যাদের জীবন উৎসর্গে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একই সঙ্গে প্রত্যয় ব্যক্ত হবে সমৃদ্ধ আগামীর বাংলাদেশ গড়ার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সীমিত ভাবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দিবসটি পালিত হবে এবার। দিবসটি উপলক্ষে সারা দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালিত হবে নানা কর্মসূচি।

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেটির উদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের মহামুহূর্তটি সূচিত হয়েছিল আজকের এই দিনে। ৯১ হাজার ৫৪৯ পাকিস্থানি সৈন্য প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করেছিল। ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত্‌ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। দেনদরবার নয়, কারও দয়ার দানে নয়, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পর নত মস্তকে পাকিস্থানি বাহিনী পরাজয় মেনে নেয়। পৃথিবীতে নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আর এই বিজয়ের মহানায়ক হিসাবে যিনি ইতিহাসে চির অম্লান ও ভাস্বর হয়ে আছেন তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আনন্দ অনেকভাবেই আসতে পারে জীবনে। কিন্তু মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা যুদ্ধজয়ের আনন্দের কোনো তুলনা হয়! ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৪৭ বছর আগে আজকের এই দিনে উদিত হয়েছিল বিজয়ের লাল সূর্য। মুক্তিপাগল বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলো। যে সূর্য কিরণে লেগে ছিল রক্ত দিয়ে অর্জিত বিজয়ের রং। সেই রক্তের রং সবুজ বাংলায় মিশে তৈরি করেছিল লাল সবুজ পতাকা। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অর্জনে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। নয় মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বস্তুত: বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণ একদিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে এই জাতির ঘাম ঝরানো সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের মহান সেনাপতি হিসেবে কাউকে বিবেচনা করতে গেলেই উচ্চারিত হবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু মানেই আমাদের নতুন অস্তিত্ব। ৫৫ হাজার বর্গমাইল জুড়েই তাঁর অস্তিত্ব বিদ্যমান।

ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি রক্ত দিয়েছে। লড়াই করেছে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে। সোয়া ২শ’ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম ও লড়াইয়ে রক্ত দিয়েছে এই বাঙালি জাতি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্থান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনেও ছিলো বাঙালিদের অবদান। বাঙালিরাই ছিলো পাকিস্থান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর। কিন্তু কয়েক বছরেই বাঙালির স্বপ্নভঙ্গ হয়। যে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা ইংরেজদের বিতাড়িত করেছিলো সেই একই রকম শোষণ বঞ্চনার মুখোমুখি হয়ে পড়ে কয়েক বছরের মধ্যেই। শুরু হয় সংগ্রামের নতুন যুগ। পাকিস্থানীরা এ ভূখন্ডের মানুষকে তাদের তাঁবেদার মনে করতো। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত করতো বাঙালিদের। এমনকি নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতেও তারা অস্বীকার করতো। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৪৮-এ বাংলা ভাষার দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথ বেয়ে ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ’৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ’৫৮-এর মার্শাল ’ল বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফার আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান, ৬-দফা ভিত্তিক ’৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ খ্যাত কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ ও পাকিস্থানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন প্রভূত ঘটনা প্রবাহের মধ্য স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালির উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হলে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) হানাদার পাকিস্থানি বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে এবং পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় ঘটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.