বিএনপি-জামায়াতের আদালত বর্জন কর্মসূচি কতটা সফল?

প্রশান্তি ডেক্স ॥ গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিচারের নামে অবিচার বন্ধসহ কয়েকটি দাবিতে সারা দেশে আদালত বর্জনের কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী। দল দুটি তাদের কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে একদিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। অপরদিকে সরকার দলীয় আইনজীবী নেতারা এ ধরনের কর্মসূচিকে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের পরিপন্থি এবং বিচার কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন।

গত ২৭ ডিসেম্বর সারা দেশে আদালত বর্জনের কর্মসূচির ঘোষণা দেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এরপর তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন জামায়াত ইসলামের আইনজীবীরা। এর ধারাবাহিকতায় গত ১-৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগসহ সারা দেশের আদালত বর্জনের কর্মসূচি চলমান রয়েছে।

কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা চাই, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগ নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করুক। আমরা আদালতের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আমরা এই আন্দোলনের মাধ্যমে একটি জিনিস সবাইকে স্মরণ করে দিতে চাই যে, আদালত জনগণের জন্য। আদালতের জন্য জনগণ নয়। এই জনগণ যাতে করে আদালত কর্তৃক নিষ্পেশিত না হয় এবং আদালত তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারে। কোনও প্রশাসনিক যন্ত্রের কাছে মাথানত না করে, সেসব কথা চিন্ত করে আইনজীবীরা আদলত বর্জন করে যাচ্ছেন।’ 

তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘গত ১ জানুয়ারি আদালতের প্রথম দিনে আমি ঢাকা জজ কোর্টে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি দেখেছি, আদালত পুরোদমে চলছে। কেউ কেউ (আইনজীবীরা) আদালতে যাননি, তাতে আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় কোনও সমস্যা হয়নি। অবকাশ শেষে গত ২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট খুলেছে। সেদিন আপিল বিভাগে আইনজীবীরা কানায় কানায় পূর্ণ ছিলেন। হাইকোর্ট বিভাগেও পুরোপুরিভাবে মামলার কার্যক্রম চলছে। তাদের  বর্জনের কোনও প্রভাব আদালতে পড়েনি। অনেকেই তাদের জুনিয়রদের পাঠিয়ে মামলার শুনানি করিয়ে আসছেন।’

গত ৩ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামিন শুনানির দিন ধার্য ছিল একটি হাইকোর্ট বেঞ্চে। এদিন আদালত বর্জন কর্মসূচিতে সিনিয়র আইনজীবীরা ব্যস্ত থাকায় জামিন শুনানি আগামী সপ্তাহে রাখার আরজি জানিয়ে শুনানি করেছিলেন জুনিয়র আইনজীবীরা। জবাবে হাইকোর্ট বলেছিলেন, ‘জামিন শুনানি তখন এত জরুরি ছিল, এখন পেছাতে এসেছেন কেন?’ পরে অবশ্য আদালত শুনানি পেছানোর আবেদন মঞ্জুর করেন।

কর্মসূচির বিষয়ে ইউনাইটেড ল ইয়ার্স ফ্রন্টের (ইউএলএফ) কো-কনভেনর সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার জন্য যুগ যুগ আন্দোলন করেছেন। এবং আমরা অনেকটা সফল হয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো— গত ১৫ বছর ধরে বর্তমান সরকার আদালতসহ সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে এবং আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদের কারাগারে পাঠিয়েছে। অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে তাদের সাজা দিচ্ছে। এটা অগ্রণযোগ্য। তার প্রতিবাদ হিসেবে দেশের বিচার বিভাগ যাতে আগামী দিনে তাদের  দায়িত্ব যেন যথাযথভাবে পালন করতে পারে, সেজন্য এই আদালত বর্জনের মধ্য দিয়ে তাদেরকে  একটি মেসেজ দিচ্ছি।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন একটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা এবং বাধ্য-বাধকতা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতার জন্য নির্বাচন অপরিহার্য। সারা দেশে নির্বাচনি আবহ তৈরি হয়েছে। কিছু রাজনৈতিক দলের আইনজীবীরা ফোরামের নামে ১ থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত আদালত বর্জনের যে ডাক দিয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত। এরূপ কর্মসূচি দেওয়ার কোনও এখতিয়ার কোনও আইনজীবী ফোরামের নেই। এ ধরনের আহ্বান গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের পরিপন্থি এবং বিচার কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ। এই কর্মসূচি বিচারপ্রার্থী মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারের পরিপন্থি। বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশে সন্ত্রাস এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। এই অপশক্তি বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করেছিল। আবার তারা বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত রয়েছে। এ ধরনের কর্মসূচি পালন করে তাদের অর্জন শূন্য।’

এদিকে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ ও সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট শাহ আহমেদ বাদল গত ১ ডিসেম্বর অ্যাডহক কমিটির প্যাডে প্রধান বিচারপতি বরাবর চিঠি দেন।

সেই চিঠিতে, আদালত বর্জন কর্মসূচি চলাকালে মামলা সংশ্লিষ্ট যেসব আইনজীবী শুনানিতে অংশ নিতে অথবা নির্ধারিত তারিখে আদালতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না, সেসব মামলার পরবর্তী কার্যক্রম আগামী ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করার কথা বলা হয়। জানা গেছে, ওই চিঠিতে আদালত অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। তাই আদালত অবমাননার ব্যাখ্যা দিতে তাদের তলব করা হয়েছে। আগামী ১১ জানুয়ারি দুই চিঠিদাতাকে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতেও বলা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.