প্রশান্তি ডেক্স ॥ অফিস শেষে প্রতিদিনের মতো হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন দীপান্বিতা বিশ্বাস। সেসময় তার মাথার ওপর একটি ইট পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। গত বুধবার (১০ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক ছিলেন। কর্মরত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সদরঘাট শাখায়। দীপান্বিতা দম্পতির একটি ফুটফুটে শিশু সন্তান রয়েছে। বাসায় হয়তো সে মায়ের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু দীপান্বিতার আর ফেরা হয় না।
পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। ২০২১ সাল। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার মমিনবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে পথচারী রুনা আক্তার (২২) নিহত হয়েছিলেন। তিনি স্থানীয় মোল্লা গার্মেন্টসের একজন পোশাক শ্রমিক ছিলেন।
নতুন ভবন নির্মাণে শ্রমিক এবং পথচারীদের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মানছেন না অনেক ভবন মালিক এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।
অভিযোগ রয়েছে, কয়েকটি বড় বড় ডেভেলপার কোম্পানি ছাড়া বেশিরভাগ ভবন মালিকরা ভবন নির্মাণে কোনও আদর্শ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করছে না। ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়ার সময় প্রত্যেকে সব নিয়ম মানার শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করলেও তার বেশিরভাগই মানছে না।
গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক দীপান্বিতা বিশ্বাসের মৃত্যুর ঘটনায় তার স্বামী তরুন বিশ্বাস বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) রমনা মডেল থানায় অজ্ঞাতদের আসামি করে এ মামলা করেন। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী, ‘যদি নির্মাণকাজ কোনও রাস্তায় বা স্থানে জনসাধারণের জন্য বাধা-বিপত্তি অথবা অসুবিধা সৃষ্টি করে, তাহলে আবেদনকারী কর্তৃক সেই স্থানে অস্থায়ী ঘের, জীবন রক্ষাকারী বাধা এবং বিকল্প চলাচল পথ তৈরি করে জনসাধারণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্মাণ প্রকল্পের দ্রব্যাদি ও জিনিসপত্র জনপথে কিংবা ফুটপাতে রেখে জনসাধারণের চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করা যাবে না। আবাসিক এলাকায় সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কোনও যন্ত্রপাতি ব্যবহার বা নির্মাণ পদ্ধতির মাধ্যমে নির্মাণসাইট বা প্রকল্প স্থলে বিরক্তিকর কোনও আওয়াজ বা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যাবে না এবং দিনরাতের কোনও সময় সাইটে ইট বা পাথর ভাঙ্গানো মেশিন ব্যবহার করা যাবে না।’
ভবন নির্মাণকালে যে নিয়মগুলো মানার কথা আইনে বলা আছে সেগুলো মানলে এই পথচারী মৃত্যু বন্ধ হতো বলে মনে করেন আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সেটা কেউ মানছেন না। একেকটি দুর্ঘটনা ঘটে এবং আদালত টর্ট আইন অনুযায়ী ক্ষতি পরিমাপ করে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু অবহেলাজনিত মৃত্যুর সুরাহা পেতে যে মামলা করা যায়, সেদিকে সাধারণত যেতে দেখা যায় না। এটা অবশ্যই কেবল ক্ষতিপূরণ নয়, বিচারের মাধ্যমে সাজা নিশ্চিত করার দিকে যাওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।’
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৬ জুলাই অসুস্থ মাকে হাসপাতালে দেখে ফেরার পথে পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালের সামনে একটি নির্মাণাধীন ১৮ তলা ভবন থেকে ইট পড়ে মারা যান তেজগাঁও কলেজের ছাত্র হাবিবুর রহমান। এ ঘটনার পর হাইকোর্ট বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চান। একইসঙ্গে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় ডেভেলপার কোম্পানির চেয়ারম্যান, রাজউক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। পরবর্তীকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে।
একটি নগরে কীভাবে এত অদায়িত্বশীল আচরণ চলে প্রশ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘এ ধরনের মৃত্যু মর্মান্তিক এবং পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কেবল পথচারী নয়, প্রতিনিয়ত নির্মাণ শ্রমিকরাও মৃত্যুবরণ করছেন। কেবল মৃত্যু নয়, পংগু, আহত হচ্ছেন কতজন, তার প্রকৃত হিসাব নেই। এসবই ঘটে চলেছে, কারণ নির্মাণ ব্যবস্থাপনা তদারকি করা হয় না। আমাদের যে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, সেটা আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেগুলো পালন করা হয় না। ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়ার সময় যিনি বানাবেন, তিনি সব মেনে চলার কথা বলেন। কিন্তু তারা সেটা মানেন না বলে আমাদের নাগরিক জীবন কেন তুচ্ছ হবে, সে প্রশ্ন তোলা জরুরি।’