প্রশান্তি ডেক্স ॥ নির্জন পাহাড়ের ফাঁকে উড়ছে জাপানি পতাকা। তার পাশে একটি লালসবুজের পতাকা। মাঠে শিশুদের সঙ্গে নাচানাচি করছেন কয়েকজন বিদেশি। সাদা চামড়ায় ভাঁজ পড়া লোকেরা জাপান থেকে এসেছেন। ভাঙ্গা বাংলায় শিশুদের শেখাচ্ছেন সালাম, ধন্যবাদ আর ওয়েলকাম। আরেকপাশ দিয়ে লাইনে গলায় চকলেটের মালা নিয়ে আসছে আরেক দল শিশু। তারা এবার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হবে। এই শিশুদের বরণ করতেই জাপানি নাগরিকদের এই আয়োজন।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই পাহাড়ের গহিন এলাকা বড় ধর্মপুরে স্কুলটির অবস্থান। গত বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, স্কুলের প্রধান ফটকে জাপানি, ইংরেজি ও বাংলায় স্কুলের নাম লেখা। ফটকের ওপরে উড়ছে সবুজের ওপরে লাল বাংলাদেশি ও সাদার ওপরে লাল বৃত্তের জাপানি পতাকা।
শিক্ষার্থীদের পরনে সবুজ প্যান্ট ও সাদা জামা। কারো চেয়ার টেবিল লাল ও সবুজ রঙ্গের। কারোগুলো সাদা। ১ম-থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়ানো হয়। প্রতি শ্রেণিতে ২০ জন করে শিক্ষার্থী ১০০ জন। গত বৃহস্পতিবার প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বরণ ও খেলাধুলার আয়োজন ছিল। তাই তাদের সঙ্গে জাপানিদের মজা করতে দেখা যায়।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে নির্জন জঙ্গলে গড়ে ওঠে মজুমদার ওয়ান ড্রপ প্রাইমারি স্কুল। এটির ৪০ ভাগ ব্যয় বহন করেন কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার তারিক-উল- ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রী নাহিদা আক্তার মজুমদার। বাকিটা বহন করেন তাদের জাপানি বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক তোশিকো ওনিশি ও তার বন্ধুরা। তোশিকো ওনিশি অবসরে জাপানের বিভিন্ন স্কুলে বাংলাদেশি খাবার বিক্রি করেন। সেই টাকা দিয়ে এই স্কুলে সহায়তা করেন। গত বৃহস্পতিবার চার জাপানি বন্ধু আসেন লালমাই পাহাড়ের মজুমদার ওয়ান ড্রপ প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে তারা জানান স্কুল প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।
স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল ইয়াসমীন আলী বলেন, এখানের অধিকাংশ শিশুর পরিবারের কেউ স্কুলে যায়নি। কারও মা নেই পরিবারে। কারও বাবা নেই। নানা বা দাদার পরিবারে বড় হচ্ছে। কেউ কেউ সকালের খাবার খেয়ে স্কুলে আসতে পারে না। এখানের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেয়ারও কেউ নেই। বইয়ের সঙ্গে তাদের জীবন পরিচালনা ও পরিচ্ছন্নতায় আমরা গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
তোশিকো ওনিশি বলেন, শিশুদের মুখের হাসি দেখতে জাপান থেকে এসেছি। কখনও কখনও জাপানে বাংলাদেশি খাবার বিক্রি করি। এতে যা আয় হয় তাই তাদের জন্য পাঠাই। এখানে এলে মন ভালো হয়ে যায়। যেহেতু বয়স হয়েছে। পরিবার সবসময় আসতে দেয় না। কিন্তু আমাকে কেউ আটকাতে পারে না। জাপানে তরুণের সংখ্যা কম, এখানের তরুণদের দেখে হিংসে হয়! তাদের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা কোনও এনজিও নয়। বন্ধুরা নিজেদের আয় থেকে অংশ নিই। বয়স হয়েছে। কতদিন চালাতে পারবো জানি না। কেউ ইচ্ছে করলে স্কুলের খরচ বহনে অংশ নিতে পারে।
সংস্কৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে ওনিশি বলেন, জাপান বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভিন্ন। তবে আমার ভালো লাগে এদেশের সংস্কৃতি। বিশেষ করে বিরিয়ানি। এখানকার মানুষ অতিথি পরায়ণ। খুব মিশুক। তবে মানুষ সময় অনেক অপচয় করে। স্কুলের উদ্যোক্তা তারিক-উল-ইসলাম মজুমদার বলেন, জাপানে কিছু বন্ধু রয়েছে। তারা একবার কুমিল্লায় বেড়াতে আসেন। তারা কান্দিরপাড়ে কিছু ভিক্ষুককে অনেক টাকা দিতে থাকেন। বিষয়টি আমার স্ত্রী নাহিদা আক্তার মজুমদারের নজরে আসে। তিনি বলেন, এভাবে তো মানুষের উপকার হবে না। পাহাড়ের শিক্ষার আলো জ্বালাতে কাজ করা যেতে পারে। এর নিরিখে আমরা তাদের প্রস্তাব দেই। জাপানি বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক তোশিকো ওনিশিসহ তার সহপাঠীরা এই স্কুলের ব্যয় ভার বহনে সহযোগিতা করেন। প্রতি জানুয়ারি মাসে এসে তারা স্পোর্টস ডে করেন।