প্রশান্তি ডেক্স ॥ নারীরা গৃহস্থালি কাজ ছাড়াও বাইরের বিভিন্ন কাজে নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ রাখছেন। তবে নারীর কর্মক্ষেত্রে আসা মানেই ঘর সামলে রেখে আসা। অর্থাৎ ঘরে ও বাইরে তাদের সমান গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হয়। অন্যান্য পেশার মতো আইনজীবী নারীরাও এর ব্যতিক্রম নয়।
গত শুক্রবার (৮ মার্চ) বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবস উপলক্ষে কয়েকজন নারী আইনজীবী পেশায় তাদের সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর গল্প তুলে ধরেছেন।
সৈয়দা ফরিদা ইয়াসমিন জেসি। পেশায় একজন নারী আইনজীবী। দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় আইন পেশায় রয়েছেন। সদ্য তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির তথ্য যোগাযোগ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে। তিনি বলেন, একজন নারীর পেশায় টিকে থাকা অনেকগুলো ‘কিন্তু’ ও ‘শর্তের’ ওপর নির্ভর করে। যেটা পুরুষকে করতে হয় না। বাবার বাড়ির বাধা, শ্বশুর বাড়ির বাধা, স্বামীর বাধা, কর্মস্থলে সহকর্মীদের বিরূপ আচরণ, ছেলেমেয়েকে মানুষ করার জন্য তাদের সময় দেওয়া, স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসা, তাদের খেয়াল রাখা, উপরন্তু, স্বামীর মন জুগিয়ে চলাসহ অনেক ‘কিন্তু ও শর্তের’ ওপর একজন নারীকে টিকে থাকতে হয়। অনেক নারী বিয়ের আগে ভালো কোনও চাকরি করলেও বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোক চায় না বলে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। স্বাধীন ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল এক নারী পরাধীন ও স্বামী-শ্বশুর বাড়ির মুখাপেক্ষী হয়ে যান।
তিনি বলেন, একজন আইনজীবী নারীও এর ব্যতিক্রম নয়। কাকডাকা ভোরে উঠে পরিবারের কাজ করে জ্যাম ঠেলে সকাল ৯টায় নিয়মিত আদালতে আসতে হয়। সারা দিন সিনিয়রের সঙ্গে আদালতে আদালতে ঘুরেও একজন ছেলে আইনজীবীর সমান সম্মানী পান না। ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে ৩০ হাজার আইনজীবীর মধ্যে প্রায় ৭ হাজার নারী আইনজীবী। সমিতির নির্বাচনসহ সবক্ষেত্রেই নারীরা বঞ্চনার শিকার।
অনন্যা সুলতানা। পেশায় একজন আইনজীবী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক। নারী দিবস উপলক্ষে তিনি বলেন, আমার এই পেশায় আসতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। স্বীকার করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষাও। প্রথমে কেউও মানতে রাজি হয়নি, আমি আইন পেশায় আসি। বাবা-মা ছাড়া নিকটতম আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার বিরোধিতা করেছে। তাদের বক্তব্য একটা মেয়ে বড় হয়েছে, যা পড়ালেখা করার করেছে। এখন বিয়ে দিয়ে দাও। মেয়েদেরকে বেশি পড়ালেখা করাতে হয় না। বেশি পড়ালেখা করালে, তখন আর ভালো পাত্র (বর) পাওয়া যায় না। পরিবারের সঙ্গে অনেক সংগ্রাম করে আমি এই জায়গায় আসতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, আইনজীবী হওয়ার পর আমার বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন চাইতো না আমি কোর্টে যাই। আদালতে গিয়ে মামলার কাজ করি। অনেক বাধার মুখে পড়ে এখন আমি কোর্টে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। শুধুমাত্র একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পার্টটাইম শিক্ষকতা করছি। এটাও হয়তো কিছুদিন পর ছেড়ে দেওয়া লাগতে পারে। আমি যদি ছেলে হতে পারতাম, তাহলে হয়তো আমার কষ্টে অর্জিত পেশাকে ধরে রাখতে পারতাম। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের ইচ্ছে ও ভালোলাগার কোনও মূল্য নেই।
চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সব চেয়ে ছোট সাবিনা ইয়াসমিন। সাবিনা ইয়াসমিন পেশায় এক আইনজীবী। সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন তার আইনজীবী হওয়া চ্যালেঞ্জের কথা। তিনি বলেন, ছয় ভাইবোনের মধ্যে থেকে পড়ালেখা শেষ করা খুব কঠিন একটি কাজ ছিল। আমার জন্য সবকিছু খুব একটা সহজ ছিল না। পড়ালেখা শেষ করার আগে বাবা মারা যান। ওই সময় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে হওয়ার পথে। বড় ভাইয়া ও মায়ের প্রেরণায় পুনরায় আইনের ওপর পড়ালেখা শেষ করি। এরপর শুরু হয় আমার জীবনের আসল স্ট্রাগল। একজন নারী আইনজীবীকে কোর্ট প্রাঙ্গণে সবাই খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না। সারা দিন সিনিয়রের সঙ্গে আদালতে আদালতে ঘুরেও একজন ছেলে আইনজীবীর সমান সম্মানী থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। অনেক সিনিয়র বলে থাকেন, মেয়েরা নাকি ছেলেদের সমান কাজ করতে পারে না। এজন্য নাকি ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সম্মানীও কম।
তিনি আরও বলেন, কয়েকজন পুরুষ সহকর্মীর কাছে খারাপ আচরণও পেয়েছি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছি। অনেক সময় না পেড়ে ওঠলে সেই চেম্বারও ছেড়ে দিয়েছি। খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি আমার কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জের ছিল। এছাড়া দীর্ঘ সময়ে মামলার শুনানিতে আদালতে থাকা অবস্থায় ওয়াসরুম ব্যবহার করা অনেকটাই কঠিন ছিল। কারণ, আদালতের অনেক ওয়াসরুম রয়েছে যা মেয়েদের ব্যবহারের জন্য অনুপযোগী। ওয়াসরুম ব্যবহারের জন্য দীর্ঘ সয়ম অপেক্ষা করে চেম্বারে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হতো। অনেকেই বলেন, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার। হয়তো সেটা বইয়ের পাতায়, বাস্তবে ভিন্ন।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘নারী-পুরুষের যে সমতার কথা বলা হচ্ছে, সেটা এখানেও পুরোপুরিভাবে কার্যকর হয়নি। ছেলের জন্য আমরা যেভাবে ইনভেস্ট করি, মেয়ের জন্য সেভাবে করা হয় না। একজন ছেলে বা মেয়ে যখন আইনজীবী হয়ে চেম্বার আসেন, তখন বেশিরভাগই দেখা যায় ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে। এর পেছানোর কারণ মেয়েরা যেভাব আইন চর্চা করার কথা, তা তারা করতে পারছেন না। মেয়েদের মাথায় সব সময় কাজ করে বাচ্চা, স্বামী, সংসার, বাসার ভিন্ন কাজের বিষয়ে। ফলে মেয়েরা অটোমেটিক পিছিয়ে পড়ছে। এসব জায়গায় তাকে নারী হিসেবে দেখা হচ্ছে। মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। সে যে একজন আইনজীবী, সেখানেও তাকে নারী হিসেবে দেখা হয়। এই জায়গোাতে একটা বাধা। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে কর্মস্থলে সব ক্ষেত্রেই নারীদের সমতার জায়গায় দেখা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আমার কাছে অনেক খবর আসে, নারী আইনজীবীরা সিনিয়রের কাছে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু নারীরা এখানেও কোনও প্রতিবাদ করেন না। কারণ, প্রতিবাদ করলে বিষয়টি তার পরিবারের নজরে গেলে পরদিন আর তাকে কোর্টে আসতে দেবে না। এই ভয়ে অনেকেই চুপচাপ থাকেন। নারীদের কর্মস্থল যেটাই হোক না কেন, নিরাপদ করতে হবে। তবেই তারা সমাজের জন্য আরও কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা আরও সুন্দর সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় থাকতে পারবে।