প্রশান্তি ডেক্স ॥ অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও রাজধানী উন্নয়ন করপোরেশনের (রাজউক) আইন সাংঘর্ষিক। এ কারণে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়াই রাজধানীতে গড়ে ওঠা হাজার হাজার ভবনের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের আইনে ৬তলার ওপরের ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু ১০ তলার নিচের ভবনকে বহুতল হিসেবে বিবেচনা করে না রাজউক। ফলে ১০ তলা পর্যন্ত সব ভবনের নির্মাণ পরিকল্পনা অনুমোদন পেয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র ছাড়াই। এ কারণে সেসব ভবনে নেই কোনও ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, নেই অতিরিক্ত সিঁড়ি বা ফায়ার এক্সিট।
ভবনের ক্যাটাগরি অনুযায়ী, আলাদা আলাদা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার বিধান রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের বিবেচনায় যে কয়টি কারণে অগ্নিনির্বাপণ ও বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হয়, তা হলো- ভবনের আয়তন, মানুষের ঘনত্ব এবং ভবনটি বহুতল কিনা। প্রথম দুটি নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও রাজউকের মধ্যে কোনও মতবিরোধ নেই। তবে বহুতল ভবনের সংজ্ঞা নিয়ে আছে বিপত্তি।
সরেজমিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি ভবনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়- ৮, ৯ কিংবা ১০তলা সব ভবনে কেবল একটি মাত্র সিঁড়ি। আর কোনও জরুরি বহির্গমনের ব্যবস্থা নেই। এমনকি অগ্নিনির্বাপণের সিলিন্ডার বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার পর্যন্ত নেই। আর থাকলেও সেটির মেয়াদ পার হয়ে গেছে বছরখানেক আগে। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে এখানকার মানুষ কীভাবে বের হবেন তা জানেন না কেউ। এ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন রাজধানীর ভাড়াটিয়ারা।
রাজধানীর একটি ৯ তলা ভবনের ভাড়াটিয়া মোহাম্মদ বাবর উদ্দিন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ বাড়ি ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি ছাড়াই নির্মিত। তারা শুধু রাজউককে গণ্য করে। ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি আমলে নেয় না। অথচ কোনও সমস্যায় পড়লে সবার আগে ফায়ার সার্ভিসকে ডাকে। আমি যে ভবনে থাকছি এখান নিরাপদ বোধ করছি না; তবুও থাকছি। কারণ আশেপাশের সব ভবনের অবস্থা একই। কোনও ফায়ার এক্সিট নেই। দু’চারটা অগ্নিনির্বাপণ সিলিন্ডার থাকলেও সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। বাড়িওয়ালাদের বললেও কথা কানে নেয় না।
বাড়ির মালিকরা জানান, রাজউক থেকে প্ল্যান অনুমোদন যেভাবে পেয়েছেন সেভাবে ভবন করেছেন তারা। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা কোনও জবাব দেননি।
রাজধানীর পুরান ঢাকার সাততলা একটি ভবনের মালিক হাজী নান্টু মিয়া বলেন, ভবন নির্মাণে রাজউকের সবকিছু ঠিক থাকলেই চলে। আর কারও কিছুর প্রয়োজন হয় না। অগ্নিনির্বাপণের বিষয়ে তিনি বলেন, বিপদ তো বলে আসে না। আমার বাসায় অগ্নিনির্বাপণের জন্য সিলিন্ডার আছে। তবে ঘুরে দেখা যায়, আদতে তার বাসায় এমন কিছু নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, কত তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণে কী ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে হবে? ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩ অনুযায়ী, ৬ তলার ওপরে যে কোনও ভবনকেই বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এজন্য সব ক্যাটাগরিতেই নিতে হবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা।
বহুতল ভবনের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের মুখপাত্র মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, আইনে ৬ তলার ওপরের ভবনকে বহুতল ভবন বলা হয়েছে। আর এসব ভবনে অবশ্যই একটি জরুরি বহির্গমনের পথ রাখতে হবে। অপরদিকে ১০ তলার নিচে কোনও ভবনকে বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বলছে রাজউক। ফলে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয় না।
বহুতল ভবন আইনের সমন্বয় করতে রাজউক থেকে কোন ধরনের পরিকল্পনা বা আলোচনার কথা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে শাহাজাহান শিকদার বলেন, না। এখনও এমন আলোচনা হয়েছে বলে জানা নেই।
আন্তর্জাতিকভাবে আগুন নেভানোর জন্য যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, তা দিয়ে নিচতলা থেকে সবোর্চ্চ ৬ তলা পর্যন্ত পানি ওঠানো যায়। মূলত এই জন্য ৬ তলার ওপরের ভবনগুলো বহুতল ভবন হিসেবে গণ্য করা হয় বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
জানা যায়, ফায়ার সার্ভিসের আইনটি ২০০৩ সালে প্রণয়ন করা হলেও তাদের কোনও মতামত ছাড়াই ২০২০ সালে রাজউকের বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়। এই আইন রিয়েল এস্টেট, স্থপতি এবং রাজউকের কিছু অসাধু ব্যক্তির স্বার্থ উদ্ধারের জন্য করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্টরা। সেই আইনেই মূলত বহুতল ভবনের আলাদা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
যদিও রাজউকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অচিরেই ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আলোচনা করে আইন দুটিকে সমন্বয় করে বহুতল ভবনের একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ঠিক করা হবে।
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে রাজউকের বহুতল ভবনের বিষয়ে যে সমন্বয়হীনতা তা কবে দূর হবে বা এই বিষয়ে কোনও আলোচনা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রাজউকের প্রধান নগর স্থপতি মোস্তাক আহমেদ বলেন, না এখনও অগ্রগতি হয়নি। আমাদের বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে। এখনই এটা সংশোধনের সময়। আমরা আলোচনা করে বহুতল ভবন নিয়ে যে মতপার্থক্য আছে সেটি সংশোধন করবো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, আমরা স্টুডেন্ট অবস্থায় পড়েছি ঢাকা মহানগরীতে ৬ তলার ওপরের ভবনগুলো বহুতল ভবন। কিন্তু রাজকের আইনে ১০তলার উপরে। মূলত কিছু রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এবং স্থপতি তাদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য এ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। আমরা আমাদের সংগঠন থেকে সবসময় বলে আসছি এটা কখনও ঠিক হয়নি। যেসব ভবন ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই সেগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল হয়। তাই দুটি সংস্থার আইনের এই সমন্বয়হীনতা শিগগিরই দূর করা উচিত। তবেই যথাযথভাবে নগরের অগ্নিপ্রতিরোধের পরিকল্পনা নেওয়া যাবে।