প্রশান্তি ডেক্স ॥ সকাল সাড়ে ৬টায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা প্রস্তুত করে সন্তান ও স্বামীকে খাইয়ে, তাদের টিফিন প্রস্তুত করতে ৮টা বেজে যায়। সকাল ৯টায় তারা বেরিয়ে গেলে সুবহা অফিসের জন্য তৈরি হন। বাসা থেকে হাঁটা পথে অফিসে পৌঁছান ১০টার মধ্যে। দুপুরে লাঞ্চ টাইমে ছোট মেয়েটিকে নিয়ে বাসায় ফিরে তাকে খাইয়ে আবারও ফিরে যান অফিসে। বিকাল সাড়ে ৫টার পরে বাসায় ফিরে আবারও রাতের খাবার, সন্তানদের হোমওয়ার্ক, সামাজিকতার নানা বিষয় সুরাহা করা, পরের দিনের তিন বেলা খাওয়ার মেন্যু সেট করে— আগাম প্রস্তুুতি শেষে ঘুমাতে যেতে পারেন একটার পরে। এটা হলো কর্মজীবির কথা। পাশাপাশি যিনি পুরোদস্তুর গৃহীনি তিনি পুরোটা সময় জুড়েই করেন কাজ। ভোট ৬টায় ঘুম থেকে উঠে শুরু করেন এবং রাত্রা ১২টায় শেষ করেন। আর ঘুমানে যান ১২টার পরে কোন এক সময়ে। তবে তার কোন সাপ্তাহিক বা মাসিক এবং বাৎসরিক ছুটি নেই।
সুবহা বলেন, এই পুরো সময়ে আমাকে স্বামী বেশকিছু কাজে সহায়তা করেন। কিন্তু কাজগুলো আমার হয়ে গেছে। আমি কোনো দিন অসুস্থ থাকলে এই পুরো রুটিন এলোমেলো হয়ে যায়। আমি সন্ধ্যায় রেস্ট পাই না।
যারা চাকরিজীবী নন, তাদের নাগরিক দিনও এভাবেই সাজানো। বরং সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজটিও তাদেরই করতে হয়। দুই ছেলেমেয়ের দুই স্কুলে যাওয়া- আসা নিয়ে দিনে চার বার যাতায়াত করা, ২৪ ঘণ্টা তাদের দেখভাল করার কাজটিও তাদের ওপরে বর্তায়। বাসায় থাকেন এই অজুহাতে তাদের কাঁধে বাড়তি কাজের পাহাড়।
তাই বলে কি পুরুষরা কেবল ৮ ঘণ্টার কাজ করে বাকি ১৬ ঘণ্টা বিনোদন আর বিশ্রাম পেয়ে থাকেন? অধিকারকর্মীরা বলছেন, নাগরিক জীবনে পুরুষ সদস্য বাসার প্রচুর কাজে যুক্ত থাকেন। তারপরেও তাদের বিশ্রাম ও বিনোদনের সময় অপেক্ষাকৃত বেশি এবং সেটি নিশ্চিত করেন নারী।
১৮৮৬ সালে আত্মদানের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির ৮ ঘণ্টা কাজের যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; সেই স্মৃতিচারণ শত বছরের বেশি সময় চললেও; এখনও বিশ্বজুড়ে নারীরা নিয়মিতভাবে দিনে আট ঘণ্টারও বেশি কাজ করে চলেছেন। ‘আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা বিনোদন, আট ঘণ্টা বিশ্রাম’ এর যে অধিকার নারী সে নিশ্চিত করতে পারেনি। শ্রমিক নেতা ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারী বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে তার কর্মঘণ্টা বাড়িয়েই চলেছেন।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) বলছে, নারীরা বেতন এবং অবৈতনিক— উভয় কাজেই পুরুষদের তুলনায় প্রতিদিন বেশি ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। উন্নত বিশ্বে পুরুষরা সহযোগিতা করে বলে দৃশ্যমান হলেও অবৈতনিক পারিবারিক এবং যত্নের কাজে পুরুষদের তুলনায় কমপক্ষে আড়াই গুণ বেশি সময় ব্যয় করতে হয় নারীদের।
তবে নারীর এই অদৃশ্য কাজের কিছু কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য এই প্রথমবারের মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২৩ এপ্রিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ‘মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি’র দ্বিতীয় বৈঠকে নারীর গৃহস্থালি কাজের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে কমিটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বলেন, ‘কর্মজীবী একজন নারী দিনে গড়ে তিন ঘণ্টার বেশি ঘরে কাজ করেন। পুরুষকে করতে হয় দেড় ঘণ্টার কম। অপরদিকে বাইরে কাজ করেন না এমন নারী প্রায় ছয় ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজ করেন। পুরুষ করেন দুই ঘণ্টার কম। গৃহস্থালির কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে (এসএনএ) যোগ করা গেলে, জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। এই কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেটা আশান্বিত করে।’
‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘‘কিছু কাজকে আমরা সামাজিকভাবে ‘নারীর কাজ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি। যে কাজগুলো সাধারণভাবে নারীর কাজ বলা হয় সেসব কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এতে নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন হবে। গৃহস্থালি কাজ কীভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এ নিয়ে নানান ঠাট্টা তামাশাও হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক বিবেচনায় বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদদের ঠিক করতে হবে এবং এটা একেবারে আনকোরা এমন নয়।’