দুধর্ষ আসামিরা যেভাবে খালাস পেয়ে যাচ্ছে

প্রশান্তি ডেক্স ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর দায়ের করা ওই মামলায় আইসিটি ও পাবলিক পরীক্ষা আইনে অভিযোগ আনা হয়েছিল। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২৪ জুন ১২৫ জনের বিরুদ্ধে পৃথক আইনে দুটি আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা। সম্প্রতি আইসিটি আইনের অভিযোগ থেকে সব আসামিকে খালাস দেয় আদালত। কারণ হিসেবে আদালত রায়ে উল্লেখ করেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। একজন মাত্র সাক্ষী আদালতে হাজির হলেও তিনি বৈরী (অপরাধের সমর্থনে সাক্ষী না দেওয়া) সাক্ষ্য দিয়েছেন। যদিও পুলিশ বলছে, সাক্ষীদের বিরুদ্ধে আদালত থেকে সমনসহ অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও সাক্ষীদের হাজির করা যায়নি। এই সুযোগ নিয়ে আসামিরা আদালত থেকে খালাস পেয়ে গেছে।

শুধু প্রশ্নফাঁসের এই মামলাই নয়, সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও বৈরী সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে অসংখ্য মামলা থেকে সাধারণ থেকে দুধরর্ষ আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার তদন্তে ত্রুটি, যথাযথভাবে সাক্ষীদের ব্রিফ না করা, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে অনীহা এবং আসামি পক্ষ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েও অনেক সাক্ষী বৈরী সাক্ষ্য দিচ্ছে। আবার মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সাক্ষী মারা যান, অনেকেই দূরে বসবাস করার কারণে সাক্ষ্য দিতে আসতে চান না। পুলিশের সাক্ষীদেরও একই অবস্থা। কেউ কেউ অবসর নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন কিংবা দূরের কোথাও পোস্টিং হয়েছে, ফলে সাক্ষীদের হাজির করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সমন জারি করার পরেও আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার হার মাত্র ৩৬ দশমিক ৮০ ভাগ। বাকি ৬৩ দশমিক ২০ ভাগ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সবশেষ মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এসময় তিনি সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য জারি করা সমনের মধ্যে কমপক্ষে ৭০ ভাগ সাক্ষী আদালতে যেন হাজির থাকেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে জারি করা সমনের কত ভাগ সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন সেই তথ্য উপস্থাপনের জন্য ডিসি প্রসিকিউশনকে নির্দেশ দেন।

‘বানানো’ সাক্ষীও অন্যতম কারণ : সংশ্লিষ্টরা জানান, সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও বৈরী সাক্ষ্য দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো ভুয়া বা বানানো সাক্ষী। অনেক সময় পুলিশ কর্মকর্তারা উদ্ধারজনিত মামলা দায়ের করার সময় সাদা কাগজে সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেন। সাক্ষীরা কেউই উদ্ধার অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে থাকেন না। একারণে সেসব সাক্ষী হয় আদালতে অনুপস্থিত থাকেন অথবা বৈরী সাক্ষ্য দেন।

সবশেষ আলোচিত গোল্ডেন মনিরের মামলার ক্ষেত্রে সাদা কাগজের সাক্ষীদের স্বাক্ষর নেওয়ার বিষয়টি সামনে এসেছে। একাধিক সাক্ষী আদালতে গিয়ে সাদা কাগজে সাক্ষ্য নেওয়া এবং এজাহার ও সাক্ষীদের সাক্ষ্যে বাসায় অভিযানের তারতম্যের বিষয়টি আদালত বিবেচনায় নিয়ে দুটি মামলায় তাকে খালাস দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদকসহ উদ্ধারজনিত অনেক ঘটনায় পুলিশ নিজেদের সোর্স কিংবা উদ্ধার অভিযান শেষে প্রতিবেশী কাউকে ডেকে এনে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর নেন। এসব সাক্ষী আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিলে আসামিরা আইনি সুযোগ নিয়ে নেয়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, আদালতে সাক্ষীদের যথাসময়ে হাজির করা অনেক কঠিন একটি কাজ। নানা কারণে সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে যেতে চান না। আমরা সাক্ষীর উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু অনেকে ঠিকানা বদল, মৃত্যুজনিত কারণ বা আসামি পক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করার কারণেও অনেকে সাক্ষ্য দিতে চায় না।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, উদ্ধারজনিতসহ বিভিন্ন মামলায় পাবলিক সাক্ষীর পাশাপাশি পুলিশ সাক্ষীও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বছরের পর বছর মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে পুলিশ সদস্যরাও অবসর নিয়ে গ্রামের বাড়ি বা অন্য কোথাও চলে যান। আবার যারা দায়িত্বরত থাকেন তারা হয়তো এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদলি হয়ে যান। সাক্ষীদের জন্য যেহেতু কোনও ভাতা বা যাতায়াতের খরচ দেওয়া হয় না সেজন্য তারাও সাক্ষ্য দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।

‘দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ সদর দফতর থেকে সাক্ষীদের নিয়মিত ব্রিফিং করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।’, বলছিলেন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তা।

সাক্ষীর সুরক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ : সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদক ব্যবসায়ী বা আলোচিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অনেক সময় সাধারণ সাক্ষীরা আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে চান না। এমনিতেই সাধারণ মানুষ আদালত বা পুলিশি ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কা থেকে আদালত এড়িয়ে চলে। আবার আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে এলে নতুন করে শত্রু তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন অনেকে।

খোদ পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলছেন, সাক্ষীদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রবণতা আমাদের পুলিশের মধ্যে অনেক কম। সাক্ষী দিয়ে এসে কোনও ঝামেলায় পড়বে না এমন নিশ্চয়তা দেওয়া হয় না বলেই অনেকে সাক্ষ্য দিতে যেতে চায় না।

একই কথা বলছিলেন ঢাকার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবুও। তিনি বলেন, ‘সাক্ষীর সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এটা পুলিশের কাজ। পুলিশ যদি সাক্ষীর সাক্ষ্য দেওয়ার পর কোনও ক্ষতি হবে না এই নিশ্চয়তা দিতে পারে, তবে সাক্ষ্যের হার বাড়বে।’

বৈরী সাক্ষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে : সংশ্লিষ্টরা জানান, আদালতে বৈরী সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বৈরী ঘোষণা করে প্রথমে জেরা এবং পরে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে এমন প্রমাণিত হলে ব্যবস্থাও নিতে হবে। তবে বৈরী সাক্ষ্যের বিষয়ে পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগ সবসময় উদাসীনতা দেখায় বলেও অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি পুলিশ হত্যাকান্ডের একাধিক ঘটনায় সাজা না হওয়া এবং বৈরী সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনা নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে একটি বৈঠকও হয়েছে। এ সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রসিকিউন বিভাগকে আরও বেশি সতর্কতা ও সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়গুলো ভালো করে খোঁজখবর করতে বলেছেন। কেউ বৈরী সাক্ষ্য দিলে তাকে বৈরী সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করে আদালতের অনুমতি নিয়ে নতুন সাক্ষী হাজির করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।

পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেছেন, ‘আমি অনেক বৈরী সাক্ষী পেয়েছি, তাদের বৈরী ঘোষণা করে জেরাও করেছি। জেরার পর অনেকেই সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে। তবে সব সময় এটি করা সম্ভব হয় না। এজন্য সবাইকে তৎপর হতে হবে।’

আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ‘আদালতে সাক্ষী হাজিরের হার বাড়াতে হলে সাক্ষীর সুরক্ষা, সাক্ষ্য দেওয়া হলে প্রণোদনা বা ভাতা দেওয়ার সিস্টেম চালু করতে হবে। তাহলেই সাক্ষী হাজির বাড়বে। সাক্ষী হাজিরের হার বাড়াতে না পারলে মামলা জট কমবে না। মামলা জট কমাতে না পারলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও যাবে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.