প্রশান্তি ডেক্স॥ ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম ওরফে আনারকে হত্যাকান্ডের নেপথ্যে ২০০ কোটি টাকার লেনদেনের বিরোধ ছিল বলে জানা গেছে। এমপি আনারের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যবসা করতেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। আক্তারুজ্জামান শাহীন এই অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। আর এমপি আনোয়ারুল আজীম সেই অর্থ দিয়ে দুবাই থেকে বিশেষ কৌশলে ও অবৈধভাবে স্বর্ণের বার এনে ভারতে পাচার করতেন। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা ও আনোয়ারুল আজীমের পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাস সেসব স্বর্ণের বার কিনে নিতেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, এমপি আনারকে নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে নেওয়ার পর আমান ওরফে শিমুল ও তার সহযোগীরা শাহীনের বিনিয়োগের টাকা ফেরত দিতে বলেন। এ নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। পরে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, ছোটবেলার বন্ধু হিসেবে আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে আগে যৌথভাবে স্বর্ণ চোরাকারবারির ব্যবসা করলেও এমপি আনোয়ারুল আজীম সম্প্রতি ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু তাদের বন্ধুত্ব আগের মতোই ছিল।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, আক্তারুজ্জামান শাহীনকে গ্রেফতার করতে পারলে হত্যাকান্ডের মোটিভ স্পষ্ট হবে। এখন পর্যন্ত এমপি আনার ও শাহীনের বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও আমান ওরফে শিমুলের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে দুই শ’ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কলকাতায় গিয়ে এমপি আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
দুই মাস আগে পরিকল্পনা : গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, এমপি আনারের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুই মাস আগেই হত্যার পরিকল্পনা করেন। ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরা এলাকার পৃথক দুটি বাসাতে এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা করা হয়। এমপি আনার যেহেতু ঘন ঘন ভারতে যাতায়াত করেন এজন্য ভারতেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমান ওরফে শিমুল তার সহযোগী মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও ফয়সাল আলী সাজিকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফয়সাল ও মোস্তাফিজুরের দুটি পাসপোর্টই চলতি বছরের ৮ এপ্রিল ঢাকার বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে ইস্যু করা হয়েছে। পাসপোর্টে ফয়সালের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে খুলনার ফুলতলা থানার অলকা গ্রাম এবং মোস্তাফিজুরের স্থায়ী ঠিকানা খুলনার ফুলতলার যুগনীপাশা গ্রাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দুজনেরই বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকার ক-৩২/১২ নদ্দা। এছাড়া পাসপোর্ট দুটির ই-মেইল যোগাযোগের জন্য রাফসানচৌ ৪২০ নামে একটি জিমেইল একাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এমপি আনারকে কলকাতায় হত্যার পরিকল্পনা সাজিয়েই মোস্তাফিজ ও ফয়সালের পাসপোর্ট করানো হয়। ভারতীয় ভিসা সংগ্রহ করে তারা ১১ মে কলকাতায় প্রবেশ করে। হত্যাকান্ড শেষে ১৭ মে মোস্তাফিজ ও ১৮ মে ফয়সাল দেশে ফিরে আসে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেছেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তার বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের পরিকল্পনায় হত্যার কাজটি করেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমান ওরফে শিমুল।
সিলিস্তাকে দিয়ে হানি ট্র্যাপ: গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, এমপি আনারকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় পাঁচ খুনির সঙ্গে একজন নারীও ছিল। সিলিস্তা রহমান নামে ওই তরুণী আক্তারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী। দুই মাস আগেও সিলিস্তাকে নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন আক্তারুজ্জামান শাহীন। সিলিস্তাকে দিয়েই হানি ট্র্যাপে ফেলে এমপি আনারকে সঞ্জীবা গার্ডেনের ওই বাসায় নিয়ে যান।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সিলিস্তা অবশ্য দাবি করেছে, শাহীনকে সে আঙ্কেল বলে ডাকে। তাকে কলকাতায় ঘোরানোর জন্য ও কেনাকাটা করে দেওয়ার কথা বলে নিয়ে গিয়েছিল। খুনের ঘটনার সময় সে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের ওপরে ছিল। তবে এমপি আনারকে যখন ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে তখন দরজা খুলে দিয়েছিল সে। পরে যখন ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটের নিচতলার কোনার একটি কক্ষ থেকে ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ আসে তখন সে এ বিষয়টি নিয়ে আমান ও অন্যদের জিজ্ঞাসা করেছিল। তারা ফ্লোরে মল পরিষ্কার করেছে বলে জানায়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া সিলিস্তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। ঢাকার উত্তরায় একটি ফ্ল্যাটে থাকতো সে। উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। সে মূলত এস্কর্ট গার্ল হিসেবে কাজ করতো। এক বন্ধুর মাধ্যমে শাহীনের সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর থেকে শাহীন তাকে নিয়ে বিভিন্ন পার্টিতে যাতায়াত করতো। বিনিময়ে সিলিস্তাকে মাসিক হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচও দিতো শাহীন।
গোয়েন্দারা জানান, সিলিস্তা এই খুনের ঘটনা আগে থেকেই জানতো কিনা তা জানার জন্য তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সিলিস্তা অনেক চতুর। সে খুনের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করছে। কিন্তু একই ফ্ল্যাটে একজন মানুষকে হত্যার পর কেটে টুকরো টুকরো করার ঘটনাটি তার অজানা থাকার কথা নয়। কারণ এমপি আনারকে হত্যার পর চাপাতি দিয়ে হাড়গুলো কেটে আলাদা আলাদা করা হয়। হাড় কাটার শব্দও তার শোনার কথা।
হত্যাকান্ডের বর্ণনায় স্তব্ধ গোয়েন্দারাও : গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এমপি আনারকে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে তারা নিজেরাই আঁতকে উঠেছেন। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, তিনি তার পুলিশি ক্যারিয়ারে অনেক খুনের ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন, কিন্তু এত নৃশংস বর্ণনা কখনোই শোনেননি।
জিজ্ঞাসাবাদে আমান ওরফে শিমুল জানিয়েছে, কীভাবে এমপি আনারকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর হাত-পাসহ শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলাদা করা হয়। যাতে কোনোভাবেই এমপি আনারের চেহারা দেখে কেউ পরিচয় শনাক্ত করতে না পারে। মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে ধরতে অভিযান : এমপি আনার হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সিয়াম নামে এক যুবককে গ্রেফতারের তথ্য জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশিদও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে এই হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত অপর তিন যুবক জিহাদ ওরফে জাহিদ, ফয়সাল ও মোস্তাফিজকে ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, সিয়ামের সঙ্গে জিহাদও কলকাতাতেই আত্মগোপন করে আছে। তবে ফয়সাল ও মোস্তাফিজ দেশে ফিরেছে। দেশে ফেরার পর তারা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় আত্মগোপন করেছিল। গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল সেখানেও অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু অভিযানের ঘণ্টাখানেক আগে তারা ওই বাসা থেকে বের হয়ে যায়।