প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে স্ব-আরোপিত কিছু বাধা ও বিধিনিষেধ কাটিয়ে উঠছে ইউরোপ। গত সপ্তাহে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তাদের মন্তব্যে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তবে এখনও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ইউক্রেনকে একক দেশ হিসেবে সর্বোচ্চ সহযোগিতাকারী যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া হুমকি দিয়ে বলেছে, পশ্চিমাদের পদক্ষেপে একটি বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির আভাসও উঠে এসেছে রুশ কর্মকর্তাদের কণ্ঠে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্রে খারকিভ অঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতি ঠেকিয়ে দিয়েছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী। লিপ্তসি এলাকায় কিছু ভূখন্ড পুনরুদ্ধার করেছে এবং পূর্বাঞ্চলীয় রণক্ষেত্রে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ চাসিভ ইয়ারের প্রতিরক্ষা এখনও অটুট রয়েছে।
ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী মিডিয়া সেন্টার গত রবিবার বলেছে, এক সপ্তাহে রাশিয়ার ৮ হাজার ৬৫০ সেনা আহত বা নিহত হয়েছে। সেনাদের এই সংখ্যা প্রায় ১৭টি ব্যাটালিয়নের সমান। তারা আরও দাবি করেছে, রাশিয়ার ৮১টি ট্যাংক ও ১৫৩টি সাঁজোয়া যান ধ্বংস করা হয়েছে।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, খারকিভে ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আটগুণ বেশি। কিন্তু তিনি সতর্ক করে বলেছেন, খারকিভের উত্তর-পশ্চিমে বেলগোরোড অঞ্চলে আক্রমণের জন্য সেনা জড়ো করছে রাশিয়া। আল জাজিরার পক্ষ থেকে স্বতন্ত্রভাবে ইউক্রেনের দাবি করা হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ রবিবার বলেছেন, ফরাসি অস্ত্র দিয়ে রুশ ভূখন্ডে হামলা চালানোর অনুমোদন তিনি দিতে পারেন। ১০ মে খারকিভে রুশ হামলার পর থেকে নতুন করে পশ্চিমা অস্ত্র দিয়ে রুশ ভূখন্ডে হামলার চালানোর তাগাদা দিয়ে আসছে কিয়েভ।
তিন দিনের বার্লিন সফরে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ম্যাক্রোঁ বলেছেন, আমরা মনে করি যেসব স্থান থেকে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে সেখানে হামলা চালাতে ইউক্রেনকে অনুমতি দেওয়া উচিত। রাশিয়ায় থাকা ঘাঁটি থেকে ইউক্রেনীয় মাটিতে হামলা করা হচ্ছে। যেখান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছে সেখানে হামলার অনুমতি যদি না দেই তাহলে কীভাবে আমরা তাদের শহর রক্ষা করবো।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ব্যাখ্যা করে বলেছেন, বেসামরিক স্থাপনাকে নিশানা করা যাবে না। ম্যাক্রোঁর এই মন্তব্যের একদিন আগে রাশিয়া খারকিভের একটি শপিং সেন্টারে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এতে ১৬ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৪৫ জন। অনেকে এখনও নিখোঁজ।
জেলেনস্কি বলেছেন, খারকিভে হামলা রাশিয়ার পাগলামির আরেকটি নমুনা। এই ঘটনাকে আর কোনোভাবে অভিহিত করার সুযোগ নেই। শুধু পুতিনের মতো পাগলের পক্ষের মানুষকে এই নৃশংস উপায়ে হত্যা ও সন্ত্রস্ত্র করা সম্ভব।
ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা সবসময় রাশিয়া ও ক্রিমিয়া থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিহত করতে সক্ষম হচ্ছে না। ইউক্রেন দাবি করে আসছে, এমন হামলা ঠেকাতে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ও বিমানঘাঁটিতে তাদের হামলা চালাতে হবে।
এসব বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করা রুশ যুদ্ধবিমান এক মাসে প্রায় ৩ হাজার গ্লাইড বোমা ইউক্রেনে ফেলেছে। এসব বোমার ওজন প্রায় ২৫০ কেজি বা ৫০০ কেজি হয়। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্মুখভাগে রাশিয়ার হামলায় এগুলো বড় ভূমিকা রাখছে।
বর্তমানে ইউক্রেন শুধু এসব যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার চেষ্টা করতে পারে। চলতি সপ্তাহে তারা দুটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছেও। একটি খারকিভে ও অপরটি ডনেস্ক অঞ্চলে। এছাড়া রাশিয়ার এ-৫০ রাডার উড়োজাহাজের ক্ষতি করে রুশ পাইলটদের বিপাকে ফেলেছে তারা।
ইউক্রেন বলছে, এটুকু যথেষ্ট নয়। কারণ রুশ ক্ষেপণাস্ত্র, গ্লাইড বোমা ও ড্রোন অবিরাম আসছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থল অভিযান। ফলে তাদের রাশিয়ার বিমানঘাঁটি, ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকেন্দ্র এবং ইউক্রেনীয় সীমান্ত থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে জড়ো হওয়া রুশ সেনাদের ওপর হামলা চালানো প্রয়োজন।
গত রবিবার খারকিভে জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার নতুন স্থল অভিযান আসন্ন। যুদ্ধের এই পর্যায়ে সোভিয়েত আমলের এস-২০০/এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা দেশে উৎপাদিত ড্রোন দিয়ে রুশ ভূখন্ডে হামলা চালাতে পারছে ইউক্রেন। ড্রোনগুলোতে ছোট আকারের বিস্ফোরক থাকে। রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহজেই এগুলো ভূপাতিত করতে পারে।
ইউক্রেনের ন্যাটো মিত্ররা এই বিষয়টি মেনে নিতে শুরু করেছে। গত সোমবার ন্যাটোর পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি অস্ত্রের ব্যবহারের ব্যাপ্তি ও সরবরাহের গতি বাড়ানোর পক্ষে ভোট দিয়েছে।
গৃহীত ঘোষণায় আহ্বান জানানো হয়েছে, নিজেকে রক্ষায় ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক অধিকারকে সমর্থন করতে রাশিয়ায় বৈধ নিশানায় হামলা চালাতে ন্যাটো মিত্রদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের ব্যবহারের কিছু সীমাবদ্ধতা প্রত্যাহার করতে হবে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ জোটের বৃহত্তম সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বাইরে গিয়ে মিত্রদেরও এমনটি করার আহ্বান জানিয়েছেন।
দ্য ইকোনমিস্টকে ন্যাটোপ্রধান বলেছেন, ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্রে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহারের কথা বিবেচনা করার সময় এসে গেছে। যখন খারকিভে রাশিয়া সীমান্তের কাছে তীব্র লড়াই হচ্ছে, এসব অস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভূখন্ডে হামলা করতে না দেওয়ার ফলে ইউক্রেনের নিজেকে রক্ষা কঠিন করে তোলা হচ্ছে।
ম্যাক্রোঁই প্রথম ন্যাটো নেতা নন, যিনি এই বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেন। এর আগে ৩মে কিয়েভ সফরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও একই ধরনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
২০২৩ সালের মে মাস থেকে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে ২৫০ কিলোমিটার দূরপাল্লার স্কাল্প/স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে। ইউরোপের এই উদ্যোগের এক বছর পর যুক্তরাষ্ট্র গত মাসে ইউক্রেনকে ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে, যা ইউক্রেনকে ন্যাটো মিত্রদের সরবরাহকৃত সবচেয়ে দূরপাল্লার অস্ত্র।
ন্যাটোর ঘোষণার পরও মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের নারী মুখপাত্র সাবরিনা সিং গত বুধবার বলেছেন, ইউক্রেন কীভাবে রণক্ষেত্রে সাফল্য পেতে পারে তা সম্পর্কে আমাদের অবস্থান বদলায়নি। কিন্তু অন্য দেশগুলো নিজেদের সরবরাহকৃত অস্ত্র নিয়ে কথা বলতে পারে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থান বিতর্কের জন্ম দিতে শুরু করেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর খবরে বলা হয়েছে, রাশিয়ায় মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের বিরোধিতা নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।
১৫ মে কিয়েভ সফরের সময় ব্লিঙ্কেন বলেছিলেন, ইউক্রেনের বাইরে হামলার জন্য আমরা উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত করছি না। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কীভাবে যুদ্ধ করবে। তার এই মন্তব্যে মার্কিন নীতি পরিবর্তনের কিছুটা ইঙ্গিত ছিল বলে মনে করা হয়।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গত শুক্রবার বেলারুশে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এতে কোনও বিভ্রান্তি নেই যে ওয়াশিংটন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তারা দেখাচ্ছে এই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এটি একটি চাতুরী। আমরা নিশ্চিত যে যুক্তরাষ্ট্র ও অপর পশ্চিমা সরবরাহকৃত অস্ত্র রুশ ভূখন্ডে হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
জার্মানিসহ ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলো ফরাসি প্রেসিডেন্টের অবস্থানের দিকে ঝুঁকছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। গত সোমবার জার্মান চ্যান্সেলর সাংবাদিকদের বলেছেন, ইউক্রেনের উচিত রাশিয়ার সামরিক স্থাপনায় হামলা করা। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইনে ইউক্রেনের এই অধিকার রয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে বলা উচিত। ইউক্রেন আক্রান্ত হলে সে যেন নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
তবে জার্মানি এখনও ইউক্রেনে ৫০০ কিলোমিটার দূরপাল্লার তাউরাস ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়নি। ইউক্রেন এই ক্ষেপণাস্ত্র চেয়ে আসছে তাদের কাছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কোনও সময়ক্ষেপণ না করে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেন যদি ইউরোপীয় অস্ত্রগুলো দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা করে তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। পুতিন মিত্র ও যুদ্ধবাজ বলে পরিচিত দিমিত্রি মেদভেদেভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ভূখন্ডে হামলা করার অর্থ হলো একটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা।
এদিকে, ফ্রান্স ইতোমধ্যে ন্যাটোর আরোপিত আরেকটি বিধিনিষেধ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রশিক্ষণে ফরাসি সেনা পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছে প্যারিস। ন্যাটো মহাসচিব অবশ্য এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানাননি।
ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ওলেক্সান্ডার সিরস্কি টেলিগ্রামে ঘোষণা দিয়েছেন, শিগগিরই ইউক্রেনীয় মাটিতে ফরাসি প্রশিক্ষকরা সফর করবেন।
ইউক্রেনের আরেক শীর্ষস্থানীয় মিত্র পোল্যান্ড বলেছে, পোলিশ আকাশসীমায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার বিষয়টি বিবেচনা করছে তারা। ইউক্রেন মিত্র দেশগুলোকে এই আহ্বান জানিয়ে আসছে।
চলতি সপ্তাহে ইউক্রেন একাধিক দেশের সঙ্গে কয়েক বছরের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে রয়েছে স্পেন, বেলজিয়াম ও পর্তুগাল। স্পেন ও বেলজিয়াম চলতি বছরে প্রত্যেকে ১ বিলিয়ন ইউরো করে দেবে। ২০২৮ সালের মধ্যে বেলজিয়াম ইউক্রেনকে ৩০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেবে। ইউক্রেন বলেছে, নিজেদের আকাশসীমার প্রতিরক্ষার জন্য ১২০-১৩০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান প্রয়োজন।
তবে ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা সরবরাহ ত্বরান্বিত ও সম্প্রসারণে একমত নয় ইউরোপের সব দেশ। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলেছেন, সংঘাতে ন্যাটোর একটি পক্ষ হয়ে ওঠা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। হাঙ্গেরি এর বিরোধিতা করে। সরকার কাজ করছে কীভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী না হয়েও ন্যাটো সদস্য হিসেবে থাকা যায়।
রাশিয়ার সঙ্গে হাঙ্গেরির অর্থনৈতিক ও জ্বালানি সম্পর্ক রয়েছে। নিজেদের ভূখন্ড দিয়ে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করা নিষিদ্ধ করেছে দেশটি।