প্রশান্তি ডেক্স॥ কোটা আন্দোলনে গোটা বাংলাদেশ বিপর্যস্ত। শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মীসহ সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিত্যপণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও সবশেষে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছে সরকার। এখনও কারফিউ চলছে এবং এটি কবে নাগাদ তুলে নেওয়া হবে, সেটির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
নাজুক এই পরিস্থিতি অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এর একটি আন্তর্জাতিক প্রভাব রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্ধারিত স্পেন ও ব্রাজিল সফর বাতিল করেছেন। বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বর্তমান ঘটনাবলি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বা মন্তব্যও করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এমন দেশগুলো বর্তমান পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। ওই দেশগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সামাজিক কাঠামো, জটিল সমস্যা সমাধানে সরকারের সক্ষমতা, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করবে। তাদের বিচার-বিশ্লেষণ এই মুহূর্তে তেমনভাবে প্রকাশ না পেলেও ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ওইসব দেশের অবস্থান স্পষ্ট হবে।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘যেকোনও বিষয় নিয়ে যেকোনও দেশে আন্দোলন হতেই পারে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি যেভাবে আন্দোলনের বিষয়টি বিবেচনা করে, ওই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর কাছে বিবেচনার বিষয়টি ভিন্ন। তারা তাদের জাতীয় স্বার্থের আলোকে বিষয়টি বিবেচনা করে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘মোটা দাগে যে বিষয়গুলো বিদেশিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সেগুলো হচ্ছে আন্দোলন মোকাবিলায় সরকারের সক্ষমতা, যেভাবে মোকাবিলা করা হলো সেটি কতটুকু মূল্যবোধ বা মানবাধিকারকে সমুন্নত রেখে করা হলো এবং ওই দেশে তাদের যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, সেটি অব্যাহত থাকবে কিনা।’
বাংলাদেশে চলমান ঘটনাবলির উদাহরণ দিয়ে তিনি জানান যে এখানে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ রয়েছে। ওই বিনিয়োগ এখানে সুরক্ষিত থাকবে কিনা, এটি বিবেচনায় নেওয়া ওই দেশগুলোর জন্য খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা হবে।
তিনি বলেন, ‘কোটা আন্দোলন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি এখনও স্পষ্ট হয়নি। যখন ইন্টারনেট সেবা খুলে যাবে এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য জনসমক্ষে আসবে, তখন তাদের অবস্থানগুলো পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠবে।’
বাংলাদেশি ডায়াসপোরা: এটি কোনও গোপন বিষয় নয় যে আওয়ামী লীগ এবং এই সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশি ডায়াসপোরাদের একটি অংশ বিদেশি বিভিন্ন সরকার বা আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করে থাকে। কোটা আন্দোলন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ড বিষয়েও তারা সরব হবে বলে প্রতীয়মান হয়।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘বাংলাদেশি ডায়াসপোরা ছাড়াও অর্থের বিনিময়ে বেশ কিছু লবিস্ট প্রতিষ্ঠান এ বিষয়গুলো মিডিয়ার মাধ্যমে বা সরাসরি বিদেশি সরকারদের কাছে উপস্থাপন করে বাংলাদেশকে বিব্রত করার চেষ্টা করে থাকে। এবারও সে ধরনের ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে।’
মানবাধিকার পরিস্থিতি : বাংলাদেশে চলমান ঘটনাবলির সঙ্গে মানবাধিকার সরাসরি জড়িত। জেনেভাতে মানবাধিকার কাউন্সিল, হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস, বিভিন্ন বিষয়ে স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারসহ বিভিন্ন মেকানিজম, এমনকি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টেও অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘কোটা আন্দোলনে জড়িত রয়েছে শিশু, নারী, শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়। জেনেভার জাতিসংঘ অফিসে এসব বিষয়ের ওপর স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার রয়েছে। কোটা আন্দোলনে শিশু আহত বা নিহত হয়েছে কিনা, এই আন্দোলনে কোনও নারী নির্যাতিত হয়েছে কিনা বা শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়েছে কিনা, ওই র্যাপোর্টিয়াররা বাংলাদেশের কাছে সেটি জানতে চাইতে পারে।’
স্পেশাল র্যাপোর্টিয়াররা টেকনিক্যাল বা মূল বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করে। কিন্তু একটি দেশ নিয়ে তাদের সামগ্রিক রিপোর্ট যখন হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসের কাছে যায় এবং তিনি যদি নেতিবাচক মন্তব্য বা কোনও অ্যাকশন নেন, তখন সেটি রাজনৈতিক হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসের অ্যাকশন বা মন্তব্য রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। কারণ মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি যেসব দেশ অনুসরণ করে, ওইসব দেশের কাছে হাইকমিশনারের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
ভূ-রাজনীতি : প্রতিটি দেশ ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী তাদের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে থাকে। এ অঞ্চলে ভারত ও চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও উভয় দেশ ভিন্ন ভিন্ন কারণে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আবার বাংলাদেশও মনে করে ভারত তাদের রাজনৈতিক বন্ধু এবং চীন তাদের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার। উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। এখানে বিবেচনার বিষয় হচ্ছে কোটা আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশের ওপর যদি আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পায় তাহলে দেশ দুটি কী অবস্থান নেবে।
এ বিষয়ে আরেকজন কূটনীতিক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন বিষয় মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ যেসব বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে তার মধ্যে দিল্লি ও বেইজিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উভয় দেশের প্রভাব রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য উভয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে, এটি স্বাভাবিক। তবে এক্ষেত্রে যদি বেইজিংয়ের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা বেশি বৃদ্ধি পায়, তবে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ বা এ ধরনের চীনের বৈশ্বিক উদ্যোগে বাংলাদেশকে যুক্ত হতে বেইজিং উৎসাহিত করতে পারে।’