প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স ॥ কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা, অগ্নিসংযোগ, অস্ত্র লুট ও বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ওই দিন দায়িত্বে থাকা ৬৮ কারারক্ষীর সবাইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নরসিংদীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ গত বুধবার (৩১ জুলাই) দুপুরে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, জেলা কারাগারে মোট ৭৬ কারারক্ষী রয়েছেন। ঘটনার দিন আট জন ছুটিতে ছিলেন। যারা দায়িত্বে ছিলেন, সেই ৬৮ জনের সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
গত ১৯ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিকালে কয়েক হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালান। তারা কারাগারের বিভিন্ন অংশে অগ্নিসংযোগ করে এবং ভেতরে ঢুকে সেলের তালা ভেঙে দেন। সেই সুযোগে কারাগারে থাকা ৯ জঙ্গিসহ মোট ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে যান। ঘটনার চারদিন পর ২৪ জুলাই খাদিজা পারভীন মেঘলা ও ইশরাত জাহান মৌ নামের দুই নারী জঙ্গি ধরা পড়েন। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলে জানান পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান। একই দিন জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ ও জেলার কামরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
কারাগারসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ১১টি মামলা হয়েছে। নরসিংদীর আদালত পুলিশের পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান গত মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন, কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৯ জঙ্গির মধ্যে পাঁচ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আর পলাতক ৮২৬ কয়েদির মধ্যে ৫৭৫ জন কারাগার ও আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। এ ছাড়া লুট হওয়া ৮৫টি অস্ত্রের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৯টি উদ্ধার করতে পেরেছে বলে গত সোমবার নরসিংদীর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি খোকন চন্দ্র সরকার জানিয়েছিলেন।
৫ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঢাকায় বিচার হওয়ার কথা ছিল। একটি ©দুনীতি মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদনড ©পযন্ত হতে পারত। তবে মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে তার ভাগ্যরে চাকা ঘুরে যায়। বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং সামাজিক উদ্যোক্তা ড. ইউনুছ বাংলাদেশের সেবা সমর্থীত অন্তবর্তী সরকারের প্রধান নিযুক্ত হন। তবে অস্থিতিশীল এই সময়ে বাংলাদেশকে নতুন কওে গড়তে অনেক কাঠ-পোড়াতে হবে। ড. ইউনূস যে প্রধান তিনিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বৃটিশ সাপ্তাহিক পত্রিকা দ্যা ইকনোমিষ্ট।
গত কয়েক সম্পাহের ছাত্র আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। আন্দোলন চলাকালীন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংস দমন পীড়ন শীক্ষার্থীদের বিক্ষোভ থেকে সরাতে পারেনি। ঢাকার রাস্তায় সশস্র সেনা এবং পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিলো। আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীরা এখন নিজ দায়িত্বেই সড়কে ট্রাফিক পরিচালনা করছে এবং সংসদসহ লুটপাট করা ভবনগুলো পরিস্কার করেছে। এক রাতের ব্যবধানে বছরের পর বছর ধরে চলা স্বৈরাচারী শাসন এখন পুনরায় গণতন্ত্রে রূপ নেবে আশা দেশবাসীর।
সেই আশা কি পুরণ হবে?
বাংলাদেশের সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করাটা অনেকাংশেই কঠিন হবে। এর একটি কারণ হতে পারে শেখ হাসিনার আকস্মিক পলায়নের ফলে দেশে নেতৃত্বের যে শূন্যতা তৈরী হয়েছে সেটি পূরন করা। এই শুন্যতাকে পূরন করবেন তা এখনও ষ্পষ্ট নয়। তার আওয়ামী লীগ দল এখন কুখ্যাত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। হাসিনার পদত্যাগের পরপরই কাগাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদি দল (বিএনপি) এর নেত্রী খালেদা জিয়া। তবে ৭৮ বছর বয়সী এই নেত্রী বর্তমানে অসুস্থ্য এবং শখে হাসিনার আমলে তার দল বিএনপি একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্থানিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে আধিপত্যে বিস্তার করেছিল বিএনপি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী কর্তৃত্ববাদী শাসন বাংলাদেশে নতুন এবং আরও উদারপন্থি শক্তির উত্থানকে বাধা দিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামপন্থি দলগুলো আরও শক্তিশালি হয়ে উঠেছে। তারাও এখন নেতৃত্বেও এই শূণ্যস্থান পূরণ করতে চাইতে পারে। তবে এই চ্যালেঞ্জটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারাও এখন নেতৃত্বের শুন্যস্থান পূরণ করতে চাইতে পারে। তবে এই চ্যালেঞ্জটি আরও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, বাংলাদেশ এখন চীন ভারত এবং পশ্চিমাদের মধ্যে একটি ভূ-রাজনৈতিক রণক্ষেত্রের পরিণত হয়েছে।
তবে প্রাথমিকভাবে আশা জাগানিয়া কিছু লক্ষণ দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় পর সংযম দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। ওইদিনই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান অন্তবর্তী সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। পরের দিন ড. ইউনূসকে তত্ত্ববধায়ক প্রশাসনের নেতৃত্বে দেয়ার মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদেও দাবির কাছে মাথা নত করনে তিনি।
প্রথম চ্যালেঞ্জ
দ্য ইকোনমিষ্টের মতে, ৮ আগষ্ট প্রত্যাশিতভাবে শপথ নেওয়ার পর ড. ইউনুছের প্রথম কাজ হবে দেশে আবার শান্তিপূর্ণ রাজনীতি নিশ্চিত করা। দেশের সরকারী চাকজরিতে কোটার সংস্কার চেয়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিয়োছি। জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে ছাত্ররা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদেও সব ধরনের সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাং কোটার বিরোধিতা করেছিলেন। প্রতিবাদকারীরা যুক্তি দেখিয়েছিলেন এই সিষ্টেমে মূলত অঅওয়ামী লীগের সদস্যরাই উপাওে এসেছে। বিক্ষোভকারীদের দমনের চেষ্টায় সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিল সরকার। এই আন্দোলনে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
আন্দোলনে তোপের মুখে অবশেষে কোটা বাতিল ঘোষণা দেয় আদালত। তবে তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ইতোমধেই কোটা সংস্কার আন্দোলন বছরের পর বছর ধরে চলা শখে হাসিনার স্বৈরাচারি শাসনে অতিষ্ট জনগণের হতাশাকে উস্কে দিয়েছিল। চলতি সপ্তাহের শুরুতে তার বাসভবনে ভাংচুর এবং পুলিশ ষ্টেশনে ও আওয়ামী লীগ মন্ত্রীদেও বাড়িতে হামলার ঘটনাগুলো প্রতিবাদকারীদেও ক্ষোভেরই প্রতিফলন। অব্যাহত এই অশান্তির ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে ৭ আগষ্ট দেশবাসিকে শান্ত হওয়ার আহবান জানান ড. ইউনুছ। দেশবাসির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা শান্ত থাকুন এবং আপনার চারপাশের মানুষদের শান্ত থাকতে সহযোগীতা করুন।
দ্বীতিয় চ্যালেঞ্জ
ড. ইউনূসের পরবর্তী কাজ হবে বাংলাদেশের রাজনীতি পুর্নগঠন করা। আর এর জন্য শুধু দ্রুত নতুন নির্বাচনের আয়োজনই যথেষ্ট নয়। তাকে আর বেশি কিছু করতে হবে। দেশের আদালত ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরামত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতির প্রভাব কমাতে হবে। দীর্ঘদিন ধরেই সেগুলো অস্থিরতার উৎস হিসেবে কাজ করছে। একইসঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোকে সংগঠিত হওয়ার জন্য সময় ও সুযোগ দিতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো ছাড়া একটি নতুন নির্বাচন সহজেই ইসলামপন্থি গোষ্ঠী বা একটি পুর্নগঠিত বিএনপির পক্ষে যেতে পারে। তবে এই শক্তিগুলোও দলকেন্দ্রীতায় ভুগছে।
তৃতীয় চ্যালেঞ্জ
ড. ইউনূসের জন্য তৃতীয় বড় চ্যালেঞ্জে হল একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরী করা। বংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ ভারত সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার সবচয়ে বড় উৎস। আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেশটির একটি ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগকে এই অঞ্চলে ইসলামপন্থীদেও বিরুদ্ধে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে দেখে ভারত। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব থেকে সতর্ক হয়ে ভারত শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য, জালানি ও সামরিক সম্পর্ক সম্পসারিত করেছে। নির্বাসনে যাওয়া আয়রন লেডি হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্বেষী বাংলাদেশী জনসাধারণে মুখোমুখি হয়েছে ভারত। এই জনতার অনেকেই তাকে আর সমর্থন করেন না। এছাড়া নিজ দেশে ভারত বাংলাদেশে অবস্থানকরা আনুমানিক ১০ হাজার ভারতীয় নাগরিক এবং সেইসঙ্গে সেখানকার বসবাসকারী ১ কোটি ৪০ লাখ হিন্দু সংখ্যালঘুদেও সুরক্ষায় সহায়তা করার জন্য চাপের মধ্যে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তার জন্য বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার এবং যেকোন উত্তরসূরী শেখ হাসিনার চেয়েও বেশি চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে। এমন না যে তিনি চীনের প্রতি বিরুপ ছিলেন। তার শাসনামলে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশিদার, দ্বীতিয় বৃহত্তম বিদেশী বিনিয়োগকারী, তৃতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা এবং সামরিক প্রযুক্তির প্রধান উৎস হয়ে উঠে। তবুও চীনের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল না হওয়ার জন্য ভারত ও অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে সতর্ক ছিলেন শেখ হাসিনা।