প্রশান্তি ডেক্স॥ হত্যার শিকার হওয়ার মাত্র সাত মাস আগে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাঁর সংসদীয় বক্তব্যে প্রথমবারের মতো ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, চার বছর পরে এসে তিনি কিছু পরিবর্তন জরুরি বোধ করেন। এর আগে ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে একের পর এক আওয়ামী লীগের অনেকগুলো সমাবেশ পরিচালনা করেন তিনি, যেখানে বারবারই তিনি তার এই আরেকটি ‘বিপ্লব’ এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেন।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ওই ভাষণে তিনি নতুন বাংলাদেশকে গড়ার লক্ষ্যে সাময়িকভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা দেন। তিনি নিজেই তখন অনেক কিছু বদলে দেওয়ার রাস্তা খুঁজছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই ভাষণটি ছিল বঙ্গবন্ধুর শেষ ভাষণ।
জাতির পিতার কাছে প্রথম বিপ্লবটি ছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জন। বাকশাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, এ বিপ্লবের লক্ষ্য হলো ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। ১৯৭৫ সালের স্বাধীনতা দিবসে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি যে কো-অপারেটিভ করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে, এর ওপর বাংলার মানুষের বাঁচা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুল প্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পাজামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। আর গ্রামে গ্রামে যেয়ে এই কো-অপারেটিভকে সাকসেসফুল করার জন্য কাজ করতে হবে। যুবক চাই, ছাত্র চাই, সবাইকে চাই।’ বিশ্লেষকরা মনে করেন, মাঠ তখন বাকশালের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
সেদিনের বক্তব্যে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে হতাশার সুরও শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘আমি মানুষকে বললাম, আমার ভাইদের বললাম, মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের বললাম, তোমরা অস্ত্র জমা দাও। তারা অস্ত্র জমা দিলো। কিন্তু একদল লোক আমার জানা আছে যাদের পাকিস্থান অস্ত্র দিয়ে গিয়েছিল, তারা অস্ত্র জমা দেয়নি। তারা এসব অস্ত্র দিয়ে নিরপরাধ লোককে হত্যা করতে আরম্ভ করলো। এমনকি পার্লামেন্টের পাঁচ জন সদস্যকেও তারা হত্যা করলো। তবুও আমি শাসনতন্ত্র দিয়ে নির্বাচন দিলাম। কিন্তু যদি বাংলার জনগণ নির্বাচনে আমাকেই ভোট দেয়, সেজন্য দোষ আমার নয়। ৩১৫ জন সদস্যের মধ্যে ৩০৭ সিট বাংলার মানুষ আমাকে দিলো। কিন্তু একদল লোক বলে, কেন জনগণ আমাকে ক্ষমতা দিলো?’
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে সেসময় বুঝতে ভুল হয়েছিল কিনা, সে প্রশ্নের কোন সুরাহা হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন অর রশীদ দ্বিতীয় বিপ্লবকে বঙ্গবন্ধুর সিস্টেম চেঞ্জ হিসেবে দেখেছেন। কতগুলো বিষয়কে সামনে রেখে তিনি সিস্টেম চেঞ্জের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। সিস্টেম চেঞ্জের পাঁচটি কর্মসূচি ছিল। এ কর্মসূচিগুলোকে বুঝতে পারলে বঙ্গবন্ধুকে বোঝা যাবে এবং তাঁর লক্ষ্যগুলো বোঝা যাবে।
দ্বিতীয় বিপ্লবের পরিকল্পনায় কী ছিল? সে সময়ের সংবাদপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর মধ্য দিয়ে তিনি বেশকিছু পরিবর্তনের ডাক দেন। এই পর্যায়ের মূল কাজ হিসেবে, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করাকে নির্ধারণ করেন। যাতে এর সুফল কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর কাছে এক কথায় মুক্তি সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায় ছিল, অর্থনৈতিক মুক্তি। এবং সেটা কোন পথে আসবে ঠিক করতে যে পাঁচটি কর্মসূচি তিনি নিতে চেয়েছিলেন, সেই পাঁচ কর্মসূচির একটি হলো জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন (বাকশাল)। দ্বিতীয় কর্মসূচি হলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। তৃতীয় লক্ষ্য ছিল দুর্নীতির মূল উৎপাটন। চতুর্থ কর্মসূচি হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছিল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। পঞ্চমটি হলো প্রশাসন।