প্রশান্তি ডেক্স॥ সংবাদ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর কাজটি করেন সাংবাদিকরা। তাতেও আসে নানান বাধা। এমনই বাধার মুখোমুখি হয়েছেন গত বৃহস্পতিবার (১৫ আগষ্ট) বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকরা।
গত বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার স্মরণে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছেন সাংবাদিকরা। ছবি এবং ভিডিও করা যাবে না বলে প্রকাশ্যে মাইকিং করা হয়েছে। এছাড়া পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের কেউ কেউ দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয় বিভিন্ন বয়সের একদল মানুষ। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি জাতীয় বস্তু, ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প, স্টিলের পাইপ ছিল। কপালে পতাকা বেঁধে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিলেন তারা। কলাবাগান থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরমুখী বিভিন্ন ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি-চালিত অটোরিকশা, রিকশায় থাকা যাত্রীদের তল্লাশি করা হয়। এমনকি তল্লাশি করা হয় বিভিন্ন গাড়ি। বাসে করে যাওয়া যাত্রীদের জানালা বন্ধ করে বসে থাকার হুমকি দেওয়া হয় এবং বারণ করা হয় কোনও ধরনের ছবি বা ভিডিও করতে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার ১৪ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানায় বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার। সেদিন উপদেষ্টাদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে শোক দিবস বাতিলের কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
জাতীয় শোক দিবস বলবত থাকায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন অনেকে। শ্রদ্ধা জানাতে এসে হেনস্তার শিকার হন তারা। সেসব খবর সংগ্রহে বাধার সম্মুখীন হন সাংবাদিকরা।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে দায়িত্ব পালন করছিলেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক। সেখানে অবস্থান করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের ছবি তোলার চেষ্টা করেন তিনি। তখন তার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে ছবি ডিলিট করতে বাধ্য করা হয় বলে জানিয়েছে ডেইলি স্টার। সেখানে হ্যান্ড মাইকে সাংবাদিকদের ছবি না তুলতে এবং ভিডিও ধারণ করতে নিষেধ করা হয়।
ঘটনাস্থল থেকে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক জানান, সাংবাদিকদের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের আশপাশের বাসিন্দাদেরও ছবি তুলতে বা ভিডিও ধারণ না করতে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করা হয়।
ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ এক ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘অতীতের মতোই ছবি তুলতে বাধা দেওয়ার আগেই সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা নিষিদ্ধ করুন।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এমন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, সকাল থেকে মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও ধারণে আপত্তি শুরু করেন সেখানে উপস্থিত ছাত্ররা। এ বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটিও হয় তাদের। পরে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করা হয়, ‘কোনও ছবি তোলা যাবে না, ভিডিও ধারণ করা যাবে না।’
কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী মোবাইল ফোনে ছবি ধারণ করলে তাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। পরে ধারণকৃত ছবি ডিলিট করতে বাধ্য করা হয়।
ঘটনাস্থলে থাকা একটি অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমি মেট্রো শপিং মলের সামনে ফুট ওভারব্রিজে ছিলাম। নিচে রাস্তায় একজনকে পেটানোর পর তাকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এসময় ব্রিজে থাকা সবাই ছবি তোলেন, অনেকে ভিডিও করেন। বিভিন্ন টেলিভিশনও ফুটেজ নিয়েছে। তখন নিচ থেকে একজন আমাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘ছবি তুলছেন কে? ছবি তোলা যাবে না।’
সে সময় একজন রিপোর্টার জিজ্ঞেস করেন ছবি তোলা যাবে না কেন? জবাবে বলা হয়, ‘তোলা যাবে না। কোনও ছবি তোলা যাবে না।’ ওই ব্যক্তি বেশ উত্তেজিত ছিল বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমি ওপর থেকে তাকে বলি, ভাই বাদ দেন, ছবি তোলে নাই। ওই লোকের উত্তর ছিল, ‘তুললে খবর আছে, নামাইয়া পিটামু।’
গণমাধ্যমের কাজে বাধা আসায় অনেকেই নিন্দা জানিয়েছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন তাহলে কি সাংবাদিকরা কাজ করবেন না?
ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক খালেদ রায়হান জানান, সকালে সাড়ে ৭টার দিকে আমি ধানমন্ডি রাপা প্লাজার ওইদিকে অ্যাসাইনমেন্টে ছিলাম। সেখানে দেখলাম সাধারণ মানুষের ফোন চেক করা হচ্ছে। কারও কারও ফোন চেক করার পর মারধর করা হচ্ছে। এই মারধরের ভিডিও তুলতে গেলে তেড়ে আসছে। এরপর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে একজন নারীর সঙ্গে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তার গায়ে হাত তোলা হয়। তখন মাইকে বলা হয় ‘কেউ কোনও নারীর গায়ে হাত তুলবেন না।’
সাংবাদিক খালেদ রায়হান আরও বলেন, আমার সেখানে অবস্থান করে মনে হয়েছে যে তারা যখন অনুমতি দেবে তখন কাজ করতে পারবেন, আর না হলে পারবেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ফেসবুক লাইভে বলেছেন, ‘আজকে বেশ কিছু ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাদারি কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমি প্রথমেই বলতে চাই, আমরা কেবল নির্যাতকের পরিবর্তন চাইনি, আমরা নির্যাতনের পরিবর্তন চেয়েছি। আমাদের দেশে যারা সমস্যা সৃষ্টি করতো, আমরা শুধু তাদের পরিবর্তন চাইনি বরং সমস্যাগুলোর পরিবর্তন চেয়েছি। আমরা খবর পেয়েছি যে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অনেক গণমাধ্যমকর্মীকে ছবি তুলতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন। যারা মত প্রকাশ করতে চায় এবং দ্বিমত প্রকাশ করতে চায় উভয়ের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেজন্য আজকে যারা গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাদারি কাজে বাধা দিয়েছে, আমরা তার নিন্দা জানাই। অতীতের ফ্যাসিস্ট সরকার যে কাজ করেছে, সেটির পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না।’