প্রশান্তি ডেক্স ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে নিহত তোফাজ্জল হোসেনকে গণপিটুনি দেওয়ার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে। ছবিতে দেখা যায়, নির্মমভাবে পেটানোর পড়ে তোফাজ্জল মেঝেতে কুঁকড়ে পড়ে আছেন। তাকে ঘিরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে, আর সামনে কয়েকজন বসে আছে। সেখান থেকে হলের হাউজ টিউটরদের সহায়তায় তোফাজ্জলকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে গত বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জয় বাংলা’ ফটক এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মী শামীম মোল্লাকে মারধর করে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রক্টরিয়াল বডি’র হাতে তুলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে আশুলিয়া থানায় সোপর্দ করে। এরপর বুধবার রাত ৯টার দিকে চিকিৎসার জন্য সাভারের গণস্বাস্থ্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক শামীমকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, তোফাজ্জলকে দফায় দফায় মারধরের সময় সেখানে উপস্থিত ছিল ৩০ জনের মতো। তারা এমনভাবে মারধর করার কথা বলছিল যাতে সে মরে না যায়। কেউ এসে গ্যাস লাইট দিয়ে পায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। কেউ এসে তোফাজ্জলের ভ্রূ ও চুল কেটে দেয়। মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে পড়লে কেউ একজন পানি খাওয়ালে সে উঠে বসে। আবারও শুরু হয় মারধর।
এ দুই ঘটনার ভিডিও ও ছবিতে প্রকাশিত নির্মমতা ও মৃতপ্রায় একজনকে সামনে রেখে এভাবে দাঁড়িয়ে ও বসে থাকা দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে এরা কি আসলেই দেশের বরেণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী? এদিকে দুটো হত্যাকান্ডকেই ‘মব ভায়োলেন্স’ না উল্লেখ করে বৃহস্পতিবারের মধ্যে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। মানসিক চিকিৎসকরা বলছেন, জড়িত শিক্ষার্থীদের শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাকি সব শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে হবে। এবং দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে শিক্ষা কার্যক্রম চালু না করলে এ ধরনের সহিংস ঘটনার অবসান ঘটানো কঠিন হবে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, একই দিনে দুই ক্যাম্পাসে দুজনকে পিটিয়ে মারা হলো। এগুলো মব জাস্টিস না, হত্যাকান্ড। ছবিতে তাদের অবয়ব অনেকটাই স্পষ্ট। তোফাজ্জলের ঘটনায় সারা দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মানববন্ধনের কর্মসূচি নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসন দিনভর মিটিং করেছে পরিস্থিতি সামলাতে। ইতোমধ্যে শাহবাগ থানায় একটি মামলাও হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রাত সাড়ে ৮টা-৯টার দিকে ফজলুল হক হলে ‘চোর’ সন্দেহে তোফাজ্জলকে ধরে শিক্ষার্থীরা। আটকের পর রাত ১০টা পর্যন্ত হলের গেষ্টরুমে কয়েক দফা মারধর করা হয়। একপর্যায়ে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর আবারও মারধর করা হয়। দীর্ঘ জেরায় তার অবস্থার অবনতি ঘটলে রাত ১২টার দিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে ফেসবুকে পরিচয়দানকারী সজিব হোসেন তার ওয়ালে লিখেছেন নিহত তোফাজ্জলের মানসিক ভারসাম্য হারানোর কথা। পোস্টে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘বরগুনা, পাথরঘাটার সন্তান, মেধাবী সন্তান তোফাজ্জেল ভাই! ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাথরঘাটা কলেজে ভর্তি হন। ঠিক ওই সময় তার ভাগ্য তার সাথে নিষ্ঠুরতা করে। প্রেমের সম্পর্কে হতাশা থেকে সে মানসিক ভারসাম্য হারায়। বাবা-মা নেই, এমনকি বড় ভাইকেও হারিয়ে ফেলেন তোফাজ্জল। সে তারপর থেকে আমাদের স্কুলগুলোতে, বাজারে ঘুরে বেড়াতো! কে খোঁজ নেবে, হয়তো খাবারের খোঁজে আসছিল আর চোর বানাইলেন! ওরে ভাত খাওয়াইয়া মারলেন!’
মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, এটি কীভাবে রোধ করা যায় সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। কাল দেখলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যা হয়েছে। তারা তো সবচেয়ে শিক্ষিত, তাদের সচেতনতা আসতে হবে। একজন অন্যায় করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।’
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা অংশ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় ও ন্যায়বিচারের দাবিতে উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর ১৫ ও ১৬ জুলাই যারা হামলা করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বলেন, ‘প্রথমত একনায়কতন্ত্র থেকে মবক্র্যাসির উত্থান। আন্দোলনকে রোমান্টিসাইজ করে শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাশালী পরিচয়ে সামনে আনা হয়েছে। কারণ, প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সবাই বলছেন তাদের ক্ষমতায় এনেছে শিক্ষার্থীরা। এ কারণে তাদের ক্ষেপানো যাবে না। এভাবে মবক্র্যাসি উৎসাহিত হয়েছে।’
এই অনিয়ন্ত্রিত ‘মব’ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পারভীন জলি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বাস্তবতায় যখন গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ একটি দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসন পার হয়ে বড় একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন নানাভাবেই মব বা অনিয়ন্ত্রিত জনগণের পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত সহিংসতায় লিপ্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে, কোনও ব্যক্তি বা সমষ্টি যদি ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন, তাহলে তার প্রতি বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা থেকে জনগণের অত্যাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে। পাশাপাশি, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা, স্বার্থসিদ্ধি, পূর্ব শত্রুতাকেও এমন একটি ক্রান্তিকালে বিভিন্নভাবে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে লিপ্ত হিসেবে মিথ্যা প্রচার করে মানুষকে সহিংস হতে তৎপর করে তোলা সহজ হয়।’
মানসিক চিকিৎসক তাজুল ইসলাম মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা সঠিকভাবে শনাক্ত করতে না পারলে আরও বড় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। তিনি বলেন, ‘পেটানোর যে ভিডিওগুলো ছড়িয়ে পড়েছে সেসব মর্মান্তিক। কেন তারা মানবিক নন, কেন মানসিক গঠনে উদার নন, কেন বিবেচনাবোধ কাজ করে না সেই বিষয়গুলো শনাক্ত করা প্রথম কাজ। অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেটার শাস্তি হবে, আইনি প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন এই পথে হাঁটছে? তাদের মানসিক বিকাশ কেন খন্ডিত হচ্ছে সে সত্য উন্মোচিত হওয়া জরুরি।’