পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ কতটা এগোলো

প্রশান্তি ডেক্স ॥ পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পলিথিন নিষিদ্ধ করতে জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। হাটবাজার থেকে শুরু করে পলিথিন কারখানায় চালানো হচ্ছে অভিযান। তারপরও থেমে নেই এর অবাধ ব্যবহার। সুপার শপে পলিথিনের ব্যবহার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও হাটবাজারসহ মাঠ পর্যায়ে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

পরিবেশবিদরা বলছেন, পলিথিনের ব্যবহার রোধে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। পরিবেশ দূষণ রোধে যেমন জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করা। এছাড়া দরকার জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ তৈরির ওপর জোর দেওয়া।

সরেজমিন দেখা যায়, বাজার থেকে ক্রেতারা যত ধরনের পণ্য কেনেন, তার সবকিছুতে থাকছে পলিথিনের ব্যবহার। সাধারণ ক্রেতারা বলেছেন, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে দামে সস্তা ও সহজলভ্য কিছু চালু করতে না পারলে মাঠ পর্যায়ে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

কাওরান বাজারে সবজি কিনতে আসা তৌকির আহমেদ বলেন, একজন সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চাইবে কেনাকাটায় পলিথিন ব্যবহার করতে। কারণ দোকানি পণ্যের সঙ্গে পলিথিনের ব্যাগ ফ্রি দিচ্ছে। একটা পলিথিনের ব্যাগের দাম আকার ভেদে ২৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা। অপরদিকে সরকার বিকল্প হিসেবে যা দেখাচ্ছে—তা কেনা সাধারণ মানুষের কাছে বিলাসিতা। পলিথিনের মতো করে এমন কিছু তৈরি করতে হবে, যা খুব সহজেই দোকানিরা ক্রেতাদের দিতে পারে।

পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজারে মাছ কিনতে আসা সাহেদ আলী বলেন, পলিথিনের ব্যবহার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সবাই জানেন। দৈনন্দিন জীবনে পলিথিন ব্যবহারের বিকল্প এখনও সচরাচর নয়। যেমন- আমি এখন মাছ কিনলাম। আমার কাছে বাজারের একটা ব্যাগ আছে। কিন্তু আমি যদি সরাসরি মাছ সেই ব্যাগে নিই, তাহলে সেই ব্যাগটি নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আগে পলিথিনে নিয়ে তারপর আরেকটা ব্যাগে নিতে হবে।

এই ক্রেতা আরও বলেন, পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে দোকানিদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কেননা, আমরা যখন বাজার থেকে মাছ বা সবজি কিনি তখন দোকানদার পলিথিনে করেই আমাদের সেই পণ্য দেন।

পলিথিন ব্যবহারের বিষয়ে বিক্রেতারা বলছেন, পলিথিনের মতো কম দামি পরিবেশবান্ধব কিছু পেলে নিশ্চয়ই সেটি ব্যবহার করবো।

দোকানি আজিজ আহমেদ বলেন, সবাই শুধু পলিথিন ব্যবহার করতে নিষেধ করে। কিন্তু তার বিকল্প কী ব্যবহার করবো সেটি বলে না। আর যা বলে তা আমাদের জন্য লাভজনক না। পলিথিনের মতো সহজলভ্য কিছু আমাদের দিলে অবশ্যই তা ব্যবহার করবো। তখন সরকার চাইলে জেল-জরিমানা করতে পারে।

পণ্যের কেনাবেচার সঙ্গে যেমন পলিথিন যুক্ত, তেমনই গৃহস্থালির অনেক কাজেও পলিথিনের ব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। রাজধানীর ওয়ারীর গৃহিণী সাবিনা ইয়াসমিন ঝর্ণ বলেন, পলিথিন আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। যদিও এর ব্যবহার পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু এর বিকল্পও নেই। বিকল্প থাকলেও তা সহজলভ্য নয়। জিনিসপত্র কেনাকাটা থেকে শুরু করে রান্নার কাজে, এমনকি গৃহস্থালির টুকিটাকি ময়লা-আবর্জনা রাখা বা ফেলতেও পলিথিন প্রয়োজন হয়।

হাটবাজারে ব্যবহার বন্ধ না হলেও সুপার শপে এর ব্যবহার অনেকটাই কমেছে। রাজধানীর সুপার শপগুলোতে এখন পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। সুপার শপ ইউনিমাট্রের ওারী ব্রাঞ্চে গিয়ে দেখা যায়, বিক্রয়কর্মী পণ্যের সঙ্গে ক্রেতাকে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ দিচ্ছেন। তবে সেজন্য ক্রেতাকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। একটি নরমাল পাটের ব্যাগের জন্য ২৫ টাকা, আর ইউনিমাট্রের ব্র্যান্ডিং করা পাটের ব্যাগের জন্য ক্রেতাকে দিতে হয় ১৪৫ টাকা করে।

ব্যাগের জন্য বাড়তি টাকা নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ক্রেতারা। ক্রেতা ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, একটা পাটের ব্যাগের দাম কেন ১৪৫ টাকা হবে, যেখানে আগে ফ্রি পেতাম। তাছাড়া, ওনারা (ইউনিমার্ট) বলছে এটি আমি এখানে নিয়মিত নিয়ে আসতে পারবো। আমি কি এখানে নিয়মিত আসবো? টাকাটা তো ইউনিমার্ট অর্ধেক ভাগাভাগি করতে পারতো। এই ব্যাগের দাম এত বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।

ইউনিমাট্রের ওয়ারী জোনের ফ্লোর ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম নোবেল বলেন, যে পাটের ব্যাগের দাম ১৪৫ টাকা, সেটি আমাদের কোম্পানির ব্র্যান্ডিং করা। আমরা কিন্তু কাউকে বাধ্য করছি না এটা কিনতে। যার ভালো লাগছে তিনি কিনছেন। ২৫ টাকা মূল্যের পাটের ব্যাগও আছে। তাছাড়া আমরা কাগজের ব্যাগগুলো বিনা দামে দিচ্ছি।

প্লাস্টিক পণ্যের প্রস্তুতকারকরা বলছেন, হঠাৎ করে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ করা সম্ভব নয়। তারা জানান, এই খাতে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। যদি এখনই উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে ঝুঁকিতে পড়বে অন্তত ৬ হাজারের বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান। ফলে পলিথিনের যথোপযুক্ত বিকল্প না আসা পর্যন্ত, পরিবেশ সুরক্ষায় প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

পলিথিন ব্যবহার বন্ধে অন্তবরর্তী সরকারকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করার কথা বলেন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’ (ধরা)-এর সদস্য সচিব পরিবেশবিদ শরীফ জামিল। তিনি বলেন, ‘পলিথিন ও অন্যান্য প্লাস্টিক দ্রব্যসহ সব ধরনের বর্জের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। পলিথিন ব্যবহার বন্ধে সঠিক বিকল্প ব্যবস্থা না করতে পারলে এর ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় পলিথিনের বিরুদ্ধে অন্তবরর্তী সরকারের যে শক্ত অবস্থান, তা বিভিন্নভাবে ব্যক্ত করেছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টা তার কার্যালয় যমুনায় প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করেছেন। পরিবেশ উপদেষ্টা সুপার শপে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ পর্যন্ত যদি পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হয়, তাহলে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তাদের সুবিধার্থে কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ এবং নাগরিকদের সচেতনতার বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং কমিটির সভাপতি (অতিরিক্ত সচিব) তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘পলিথিন উৎপাদন বন্ধের কার্যক্রম চলছে এবং চলবে। পলিথিনের যেসব বিকল্প দেওয়া হয়েছে, তার ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।’ পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ১৫ কোটি ব্যাগ উৎপাদনের কথাও জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘পলিথিন উৎপাদন বন্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০টি অভিযান চালানো হয়েছে। সেখানে জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। এ অভিযানগুলোতে ৫০ হাজার ৫৫৬ কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়েছে। আগামীতে অভিযান আরও কঠোর করা হবে। ক্রেতাদের বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে গিয়ে পণ্য কেনার অভ্যাস বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.