প্রশান্তি ডেক্স ॥ সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (ডিসেম্বর ২৬) সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে এ কথা জানান।
সন্ধ্যায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি গঠনের বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত কমিটি বাতিল করা হয়েছে বলে এই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি জরুরি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে বলা হয়।
তিনি বলেন, এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। সদস্য হিসেবে থাকবেন— গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, পুলিশের আইজিপি, ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (সদস্য সচিব), সশস্ত্র বাহিনীর একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েট থেকে ৩ জন বিশেষজ্ঞ, একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার।
বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা আরও জানান, এই কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস এগুলো খুঁজে বের করে তিন দিনের মধ্যে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট সরকারকে দেবে। তিনি আরও জানান, প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো না গেলেও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে পুরোটাই জানানো হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীয়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সরকার কি ধারণা করছে—এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার এভাবে ধারণা করতে পারে না। সরকার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। কারণ এটা আমাদের সবার নিরাপত্তার বিষয় সচিবালয়। এখানে রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল থাকে। ফলে এ বিষয়টিকে সরকার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, যার জন্য তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করা হয়েছে।
আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লাগা এবং দুই প্রান্তে আগুনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনটা আরও আগে নেভানো যেতো কিনা, আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়েছে কিনা—এগুলো কমিটির প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত আমরা উত্তর দিতে পারবো না। আপনারা প্রথম দিকে গিয়ে থাকলে, ভিডিও করে থাকলে তদন্ত কমিটিকে দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। অনেক প্রশ্ন অনেকের মনে আছে, সব প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা আমাদের মতো দিতে থাকি, তাহলে তো তদন্ত কমিটি করে কোনও লাভ হচ্ছে না। যার যা বক্তব্য আছে, কারও কাছে কোনও তথ্য থাকলে প্রয়োজন মনে করে তদন্ত কমিটিকেই জানিয়ে দেবেন। এই ঘটনার অবশ্যই একটা সুষ্ঠু এবং বিস্তারিত তদন্ত হতে হবে। আজকের ঘটনার কারণটা যখন আমরা নির্ধারণ করতে পারবো, সে অনুযায়ী আমরা অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবো। এই ধরনের ঘটনা আর যাতে কখনো না ঘটে, সে ব্যবস্থাও আমাদের নিতে হবে। অনেক নথি পুড়ে গেছে। এখানে নিরাপত্তার ব্যত্যয় ছিল কিনা, অন্য কোনও বিষয় ছিল কিনা, কী কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে— এগুলো সবই তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখবে।
কয়টা মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়েছে এবং পুড়ে যাওয়া নথিপত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে কিনা, জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেন, প্রায় ৫টি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে গেছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়, সড়ক ও জনপদ বিভাগও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নথি কার্যক্রম অনলাইনে থাকার কারণে আমরা উদ্ধার করতে পারবো। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পুরোটাই এনালগভাবে ফাইলে হয়। তাই যে শাখাগুলোর নথিগুলো পুড়ে গেছে, সেগুলো কতটা রিকভার করা যাবে তা নিরূপণ করার জন্য মন্ত্রণালয় পর্যায়ে একটা কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটি কাজ করে প্রতিবেদন দিলে আমরা বুঝতে পারবো কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
‘ষড়যন্ত্র’ নিয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ের জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা কিছু অর্থনৈতিক অসঙ্গতি লক্ষ করেছি। বিশেষ করে পিরোজপুর জেলায় বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ লোপাটের প্রাথমিক প্রমাণ আমরা পেয়েছি। এর সঙ্গে সাবেক মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনের প্রাথমিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেটির বিস্তারিত তদন্ত এখনও চলছে। আমরা প্রথমে ধারণা করেছিলাম, তদন্তের যে ফাইলগুলো ছিল মন্ত্রণালয়ে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এটি যেহেতু জেলা পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছে, সেজন্য আমরা এগুলো উদ্ধার করতে পারবো। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তারা পিরোজপুরে আছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে পরিচালনার জন্য আমরা সচিবালয়ে খালি জায়গা খোঁজার চেষ্টা করছি।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়কে ষড়যন্ত্র বলা হচ্ছে। সরকারের কাছে কি কোনও গোয়েন্দা তথ্য ছিল—এমন প্রশ্নে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গোয়েন্দা তথ্য থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিতো। তথ্যের প্রবাহ ঠিক আছে কিনা, তা তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দেখতে হবে। কিন্তু তথ্য থাকলে আমরা বসে থাকতাম না।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ তদন্তই আলোর মুখ দেখে না, এ তদন্ত কি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে— এ প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন তারা দেবেন। আমরা সেখানে অফিস করি, এটাতো আমাদেরও নিরাপত্তার বিষয়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথির বিষয়। প্রাথমিক প্রতিবেদনের পরে তারা যখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবেন, তা অবশ্যই আপনারা পাবেন। তদন্তের স্বার্থে হয়তো প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ সম্ভব নাও হতে পারে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দ্রুততার সঙ্গেই হবে। সেই প্রতিবেদন আপনারা পাবেন।
আগুনের উৎসের বিষয়ে তদন্ত কমিটিই সঠিক বলতে পারবে। প্রাথমিক তথ্যের বিষয়টি সবাই জেনে গেছেন।
সচিবালয়ের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সেখানে নিরাপত্তার জন্য একজন একজন করে এসপি ও এএসপি, এছাড়া প্রায় ৫৬০ জনের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য আছেন। ভেতরে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এরই মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করার আগে তদন্ত করতে হয়, সেই অনুযায়ী অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, অনেককে চাকরি থেকে সরানো হয়েছে, কাউকে কাউকে ওএসডি করা হয়েছে, কেউ কেউ কারাগারেও গেছেন। প্রশাসনের গতিটা রেখে ঢেলে সাজানোর কাজ আমরা করছি। এটা এমন না যেকোনও দাগি আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে কিন্তু আমরা তদন্ত করি নাই। সরকার আইনানুগ প্রক্রিয়া ফলো করে এগোচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা অনেক ডিজিটালাইজেশনের কথা শুনে দায়িত্বে এসেছিলাম। আগুনের ঘটনার পরে আমরা দেখলাম যে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল আমাদের কোনও মন্ত্রণালয় পাচ্ছে না। নামকাওয়াস্তে একজন কর্মকর্তা ও প্রযুক্তিৃ ডিজিটালাইজেশনের সুফল আমরা পাচ্ছি না।
সচিবালয়ে নিরাপত্তার কোনও ব্যত্যয় ছিল কিনা, প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এ প্রশ্নটা আমাদেরও। সচিবালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি আদৌ ফেল করেছে? এটা কি কোনও মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় নাকি অন্য কোনও বিপর্যয়? এগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের অপেক্ষা করতে হবে। সব সম্ভাবনা মাথায় রেখে সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ধারণা করা, আলোচনা করা ঠিক হবে না।