দেলোয়ার হোসেন ফারুক॥ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ সাজু আগৈলঝাড়ার ইউএনও গাজী তারেক সালমানের বিরুদ্ধে বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় ইউএনও সালমানকে কারাগারে প্রেরণ করেন বিজ্ঞ আদালত। আবার একই দিন জামিনও পেয়ে যান সালমান। আওয়ামী লীগ নেতা সাজু মামলা বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, এই ছবিটিতে বঙ্গবন্ধুকে বিকৃত করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর গালের উপরে একটি তিল দেওয়া হয়েছে ও চুলগুলো এলোমেলো করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বাচ্চার আঁকা ছবি দিয়ে কার্ডটা বানানো হয়েছে বলে আমরা মনে করি বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এমন কোনো ছবি নেই। যে কেউ ছবি আঁকলেই কি আমরা ছেপে দিব? বঙ্গবন্ধুর ছবি শেষের পৃষ্ঠায় ছাপানোও নাকি বিরাট অপরাধ হয়েছে!
আবার পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছেন জনাব সাজু। সাজু সাহেবের কাছে বঙ্গবন্ধুর দাম মাত্র পাঁচ কোটি টাকা? সাজু সাহেবের পরিবার কি আওয়ামী পরিবার? আমরা যেহেতু তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানিনা, তাই জিজ্ঞেস করছি। বাংলাদেশে লাখ লাখ আওয়ামী পরিবার আছে। আবার অনেক পরিবারও আছে, যেখানে এক ভাই আওয়ামী লীগ, বাবা জামাত, আরেক ভাই জাতীয় পার্টির নেতা। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সাজু সাহেবের পরিবার এমন না। কিন্তু তিনি এমন একটি মামলা কীভাবে করলেন? কেন করলেন? এর পেছনে কি স্থানীয় কোনো রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক কারণ আছে?
আওয়ামী লীগের নানা সাফল্য যেমন আছে, ব্যর্থতাও কম নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী পরিবারগুলো যুগ যুগ ধরে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার শক্তিতে আওয়ামীলীগের প্রতি একধরনের ভক্তি নিয়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এই অন্ধ ভালোবাসা আওয়ামী লীগের জন্য এক বিশাল শক্তির আধার। একজন ইউএনও কিন্তু সৃজনশীলতা দেখাতে বাধ্য নন। তিনি আমলাতন্ত্রের সাধারণ নিরাপদ নিয়মেই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের কার্ড ছাপাতে পারতেন। তিনি করলেন এক অভিনব কাজ। বাচ্চাদের দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকিয়ে সেখান থেকে বাছাই করে একটি স্কেচ দাওয়াত কার্ডে ব্যবহার করলেন। সাজু সাহেবের পক্ষে হয়ত একটি শিশুকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকানোর তাৎপর্য বুঝে উঠা সম্ভব হয়নি।
বাসায় যে কোনো কারণেই হোক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক বই আছে। বইগুলোর প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে। আমার ছেলে শেখ নাফিম ইকতিদার তাঁর তিন বছর দুই মাস বয়সেও বঙ্গবন্ধুকে দেখলে চিনতে পারে। নাফিমের দাদা, মানে আমার মরহুম আব্বা, মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু হামেদও মোটা ফ্রেমের চশমা পড়তেন। তাই প্রথম দিকে নাফিম বাবু বঙ্গবন্ধুকে দাদাও বলে ফেলত। এখন আর দাদা বলেনা। বয়সের কারণে বঙ্গবন্ধুকে ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারেনা। ‘ধ’ এর জায়গায় ‘দ’ বলে ফেলে। একটি ফেসবুক পোস্টে ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল আলম নবীন বলেছেন, তার ছোট ছেলে টাকায় জাতির জনকের ছবি দেখে বলে এটা তার দাদুভাই।
শুধু আমার বা নবীনের সন্তান নয়, এদেশের লাখ লাখ পরিবারে এমনভাবেই বাচ্চারা জাতির জনককে চিনতে শিখে। এই চেনা-জানা থেকেই জন্ম নেয় ভালোবাসা। এভাবেই লাখ লাখ পরিবারে বঙ্গবন্ধু প্রজন্মের পর প্রজন্ম জীবিত থাকেন, জীবিত থাকে আওয়ামীলীগ আর এ নিয়ে রাজনীতি করে অনেকেই মন্ত্রী, এমপি হয়ে, নেতা হয়ে সমাজে বিশেষ সম্মান অর্জন করেন। এখন প্রশ্ন হল, আমার বা আপনার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে যদি ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটা ঠিকমত উচ্চারণ করতে না পারে কিংবা ছবি আঁকতে গিয়ে, স্কেচ করতে গিয়ে যদি আওয়ামী লীগের নেতাদের মনের মত না পারে তাহলে কি মামলা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে? এমন উদ্ভট প্রশ্ন কোনোদিন করতে হবে, সত্যি ভাবিনি। কিন্তু ভাবতে বাধ্য করেছে আওয়ামী লীগ নিজেই। বারবার ‘আওয়ামীলীগ’ বলছি এ কারণে যে, আওয়ামী লীগের একটি জেলা কমিটির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক পঞ্চম শ্রেণির একটি বাচ্চার আঁকা ছবি ‘বিকৃত’ হয়েছে বলে দাবি করে এ ছবি কার্ডে ব্যবহার করায় একজন ইউএনওকে জেল খাটিয়েছেন!।
যারা প্রকৃত শিক্ষিত, তারা এর মূল্য বুঝতে পারবেন। আর যারা আর্ট নিয়ে সামান্যতম ধারণা রাখেন তারা বুঝতে পারেন যে স্কেচ কী জিনিস। চারুকলার সাথে বিমূর্ততার নিবিড় সম্পর্ক আছে। বড় বড় আর্টিস্টরা এই বিমূর্ততার কথা বলে নানা কাজের বিতর্ক উতরে যান। আমরা যারা আর্ট বুঝিনা তাদের সরল মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। সে প্রশ্ন শোনে আর্টিস্টরা হেসে উড়িয়ে দেন। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল ও জগন্নাথ হলের মাঝখানে বাংলাদেশের বড় শিল্পী শামিম শিকদার নির্মিত একটি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য আছে। সেখানে, আমার কাছে মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর যে তর্জনী দেখানো হয়েছে সেটি বামহাতের। এখন বঙ্গবন্ধু কি বামহাতের তর্জনী ব্যবহার করতেন? নাকি ডান হাতের? আমার তো মনে হয় ডান হাতের। কিন্তু শামিম শিকদারের ভাস্কর্য দেখলেই আমার মনে হয় তিনি বঙ্গবন্ধুর বাম হাত ব্যবহার করেছেন। এটা আমার বোঝার ভুলও হতে পারে। এখানেই শিল্পের মজা বলে অনেকে আমাকে বলেছেন, ডান/বাম বোঝা যাবেনা, এটাই তো শিল্প। আমি মেনে নিয়েছি। শামিম শিকদারের ভাগ্য ভালো যে আমি আওয়ামীলীগ নেতা না। আওয়ামী লীগ নেতা হলে হয়ত আমি একটা মামলা দায়ের করতে পারতাম। অভিযোগ হত, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে নিয়ে হাত নিয়ে এমন ধোঁয়াশা উনি কেন সৃষ্টি করলেন!
ছোটবেলায় জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মত বঙ্গবন্ধুর উপর লেখা একটি বই উপহার পেয়েছিলাম। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী সরাইল উপজেলার সবগুলো হাইস্কুলে ‘ছোটদের মুজিব’ নামে একটি লাল মলাটের বই বিতরণ করেছিল। সে বইয়ের উপর একটি রচনা প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আব্বার নির্দেশনায় সে প্রতিযোগিতায় রচনা লিখে আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম। এরপরে পরিবার ছাড়া আর কেউ আমাকে বঙ্গবন্ধুর উপর কোনো বই উপহার দেননি। আওয়ামী লীগের কী এমন প্রোগ্রাম আছে যার জন্য এদেশের বাচ্চারা জাতির জনককে চিনতে শিখে ছোটবেলা থেকে? আমার কোনো ভাতিজা/ভাতিজিকে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কিংবা অন্য কোনো সংগঠন থেকে কোনোদিন কোনো বই বা ছবি ফ্রিতে দেয়া হয়েছে বলে জানিনা। আমি কাউকে ছোট করছিনা। আওয়ামী লীগের পদওয়ালা নেতা-কর্মী আছে কয়জন সারা বাংলাদেশে? শুধুই যদি আপনাদের ভোটে আওয়ামী লীগ ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসত, তাহলে তো আমাদের আর চিন্তা করা লাগত না। আপনারা একটা জিনিস পরিষ্কার জেনে রাখবেন, নতুন প্রজন্ম যতদিন বঙ্গবন্ধুকে জানবে, ভালোবাসবে ততদিন এই আওয়ামী লীগ টিকবে। বঙ্গবন্ধু ছাড়া শুধু এই আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশও কল্পনা করা যায়না।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর সভাপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের আকুল আবেদন থাকবে, মামলা প্রত্যাহার করতে বরিশাল আওয়ামী লীগের এই অপরিণামদর্শী নেতাকে বাধ্য করা হোক। এমন নেতা দলের জন্য কতটুকু দরকারি সেটাও এদেশের লাখ লাখ আওয়ামী পরিবারের পক্ষ থেকে বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।