বা ই॥ ২০০৭ সালের এপ্রিল মাস। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন জেনারেল হাসান মাশহুদ চৌধুরী। দায়িত্ব গ্রহণ করেই একের পর এক গ্রেপ্তার শুরু করেছেন। শুরু করেছেন দুর্নীতি বিরোধী অভিযান। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব মামলা চালাবে কে, ভালো আইনজীবী লাগবে। পরামর্শ করলেন ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে। ড. কামাল বুদ্ধি দিলেন, সব ভালো আইনজীবীদের দুদুকের প্যানেল লইয়ার করে নেবার। এর ফলে, তাঁরা আর আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতাদের আইনজীবী হতে পারবেন না। বুদ্ধিটা দারুণ পছন্দ হলো জেনারেল হাসানের। সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবীদের প্যানেল লইয়ার বানাতে শুরু করলেন। সব ডাকসাইটে আইনজীবীরা হুমড়ি খেয়ে পরল দুদুক কার্যালয়ে। একজন খ্যাতিমান আইনজীবীতো শেখ হাসিনার মামলার ফাইল ফেরত দিলেন দুদুকের আইনজীবী হবার লোভে।
একজন কিছুতেই দুদুকের আইনজীবী হচ্ছিলেন না। জানাচ্ছিলেন, তার কিছু শর্ত আছে। দুদুক চেয়ারম্যান তাঁকে চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে চা খেতে খেতে আইনজীবী বললেন ‘দুদুকের আইনজীবী হিসেবে আমি দায়িত্ব নিতে পারি, কিন্তু আমার তিনটি শর্ত আছে’। দুদুক চেয়ারম্যান শর্তগুলো জানতে চাইলেন। আইনজীবী লিখিত একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘প্রথমত: বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে এই সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত: শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো মামলায় তিনি দুদুকের আইনজীবী হবেন না। তৃতীয়ত: মামলা হতে হবে যৌক্তিক, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক নয়।’ দুদুক চেয়ারম্যান বললেন, প্রথমটা তার এখতিয়ার বর্হিভূত বিষয়। তবে, বিষয়টি অবশ্যই সরকারকে বলবো। তৃতীয় শর্তের সঙ্গে তিনি একমত পোষণ করলেন। দ্বিতীয় শর্ত নিয়ে বললেন, এটা কেন? উত্তরে আইনজীবী বললেন ‘ শেখ হাসিনা কোনো দুর্নীতি করেননি এটা আমি জানি এবং বিশ্বাস করি। আমার বিশ্বাসের বাইরে আমি কিছু করতে পারি না’। আলোচনা অনেক দূর গড়াল।
শেষে দুদুক চেয়ারম্যান উঠে এসে, করমর্দন করলেন। বললেন ‘মি. হক, আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইওর অ্যাটিচিউড।’ অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, দুদুকের প্যানেল লইয়ার হলেন ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না লড়ার শর্তে। আনিসুল হক, এখন আইনমন্ত্রী। স্বল্পভাষী, তাঁর বিষয়ের বাইরে কথা বলেন না। পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ হিসেবে তাঁর আলাদা ইমেজ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের ছেলে। অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সহযাত্রী ছিলেন। আইন পেশায় তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যত বুঝেছিলেন হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দী। এজন্যই তাঁর গাউন উপহার দিয়েছিলেন সিরাজুল হককে। আইন পেশায় যেমন সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তেমনি সৃষ্টি করেছিলেন দেশপ্রেমের অনুকরণীয় উদাহরণ।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যার পর খন্দকার মোশতাক স্ব-ঘোষিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগের এমপিদের বৈঠক ডাকলেন। ওই বৈঠকে গিয়ে সিরাজুল হক বলেছিলেন ‘তুমি কিসের রাষ্ট্রপতি, তুমি খুনি। তোমার বিচার হবে। আমি বিচার করব’। বিব্রত মোশতাক মিটিং শেষ করলেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নতুন যুগে সিরাজুল হক প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। ৯১ এর নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর নির্বাচনী এলাকায় পরাজিত হন। এসময় এরশাদ তাঁর মামলা লড়ার জন্য প্রস্তাব দেন সিরাজুল হককে। নীতিবান মানুষটি এরশাদের মামলা লড়তে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ৯৬ তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে, শেখ হাসিনা তাঁর হাতেই তুলে দেন বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচারের দায়িত্ব। প্রাণখোলা মানুষটি এই দায়িত্ব পেয়ে যেন অন্য মানুষ হয়ে যান। যেমন ইবাদতের সময় মানুষ ভুলে যায় সবকিছু। তাঁর ছেলে আনিসুল হক এবং প্রিয় শিষ্য মোশারফ হোসেন কাজলকে নিয়ে শুরু করেন পবিত্রতম কাজটি। খন্দকার মোশতাককে তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করবেন।’ এই দায়িত্ব তিনি পালন করছেন, এটাই যেন ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। নিম্ন আদালত তিনি শেষ করতে পেরেছিলেন। এরপর হাইকোর্টও তিনি শেষ করেন। ক্ষমতায় আসে বিএনপি জামাত জোট সরকার। আপীল বিভাগে ঝুলে থাকে মামলা। এক অপূর্ণতা নিয়েই চলে যান সিরাজুল হক না ফেরার দেশে। পুত্রের হাতে তুলে দেন অসমাপ্ত বিচার শেষ করার দায়িত্ব।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দ্রুতই শুরু হয় বিচার। এবার পিতার স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব তুলে নেন পুত্র আনিসুল হক। শেষ করেন পরম নিষ্ঠায়, একাগ্রতায়, মমতায়। ২০১৪ সালে পিতার পথেই আওয়ামী লীগের এমপি হন। হন আইনমন্ত্রী। কিন্তু তাঁকে কেউ মনে করবে না তিনি প্রথমবার এমপি, প্রথম মন্ত্রী। সব সময় একটা ব্যক্তিত্ব তাঁকে ঘিরে থাকে। দলবাজির মধ্যে নেই। শেখ হাসিনা যতটা তাঁর নেতা তারচেয়ে বেশি বড় বোন। আওয়ামী লীগের আইনজীবীদের কোন্দল, কোলাহলে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন মগ্নভাবে। তাঁর কাজেই যেন খুঁজে পাওয়া যায় জাঁদরেল মানুষটিকে, যিনি বলেছিলেন ‘মাননীয় বিচারপতি, বঙ্গবন্ধু না হলে আপনিও বিচারপতি হতে পারতেন না।