গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না ফেরার কি কারণ?

প্রশান্তি ডেক্স ॥ ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে চলতি মাসের ৬ তারিখ থেকে চালু হয় কাউন্টার ও ই-টিকিটিং ব্যবস্থা। কিন্তু ১০ দিন পার হতেই দেখা যাচ্ছে যাত্রী ওঠানামার কাউন্টার ব্যবস্থাই উল্টো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ বাসচালক ও শ্রমিকরা এ ব্যবস্থায় আগ্রহী নন। তাদের দাবি, নতুন ব্যবস্থায় যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও। এদিকে, বাস মালিক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস খাতে ‘কাঁচা টাকা’র লোভে এক পক্ষ শৃঙ্খলায় আসতে চাচ্ছে না।

চুক্তিভিত্তিক চালকদের অসন্তোষ : নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যাত্রীরা নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বাসে ওঠেন, ফলে চালক ও বাস স্টাফদের হাতে ভাড়া তোলার সুযোগ থাকছে না। নির্ধারিত ট্রিপপ্রতি ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হলেও চালক ও হেল্পারদের দাবি, এতে তাদের আয়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে। তাদের মতে, আগে দৈনিক তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন সম্ভব হতো, কিন্তু এখন দিনে হাজার টাকাও থাকছে না। পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার অধিকাংশ বাস চুক্তিভিত্তিক পরিচালিত হয়, যেখানে চালক ও শ্রমিকরা দৈনিক জমা ও তেলের খরচ পরিশোধের পর বাকি অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এতে মালিক তিন হাজার টাকা পান, আর বাস স্টাফরা চার-পাঁচ হাজার পান।

আর কারণেই দৈনিক জমার বাইরে যত আয় করা যায়, ততই লাভ এই হিসাব করেন বাসচালক ও হেলপাররা। এ জন্য তারা বেশি ট্রিপ দিতে চান, যত্রতত্র যাত্রী তোলেন, এমনকি প্রতিদ্বন্‌দ্বী বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়ও নামেন। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হয়।

নতুন ব্যবস্থায় মজুরি কম জানিয়ে ভিআইপি বাসের চালক ফরিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা বাস স্টাফরা বেশিরভাগ মাসে ১৫ দিন কাজ করি। একদিন করি, একদিন ছুটিতে থাকি। এখন নতুন ব্যবস্থায় ড্রাইভার, স্টাফ মিলিয়ে দিনে দুই হাজার টাকা মজুরি ধরে। এর মধ্যে খাবারের খরচ নিজেদের। ওই খরচ বাদ দিলে থাকে ১২শ-১৩শ টাকা। এইটা ভাগ কইরা নিলে দুই দিনের হিসাবে কত কইরা আসে দিনপ্রতি? একটা ব্যাটারি অটোরিকশাও তো আমার থেকে বেশি আয় করে। আবার রাস্তায় চাঁদা আমাদেরই দিতে হয়, ওইটা কেমনে দিমু?’ আগের এক ভাগ টাকাও থাকে না জানিয়ে রাইদা বাসের এক চালক বলেন, ‘আগে মালিকের জমা, তেল খরচ আর খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে আমাদের থাকতো কখনও পাঁচ হাজার, কখনও চার হাজার। কম কইরা হইলেও তিন হাজার। এখন দিন শেষে আমি চালক, আমার হাতে এক হাজার টাকাও থাকে না। এমনে করলে তো আমাদের চলবো না।’

মালিকদেরও ক্ষতির অভিযোগ: শুধু চালক-শ্রমিকরাই নন, বাস মালিকরাও নতুন ব্যবস্থায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন। নতুন ব্যবস্থা চালুর চারদিন পর বাস চালকরা নির্ধারিত কাউন্টার থেকে যাত্রী ওঠানো বন্ধ করে দেন এবং যত্রতত্র যাত্রী উঠিয়ে নিজেরা ভাড়া আদায় করেন। এতে কোম্পানি তার আয় হারাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে বাস মালিকদের আয়ে। তারাও আগের চেয়ে কম টাকার হিসাব পান।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ভিআইপি কোম্পানির একজন বাস মালিক বলেন, কাউন্টার পদ্ধতিতে চালকরা রাজি না। তাই কাউন্টার থেকে যাত্রী তুলতে অবহেলা করে। এর জন্য আমরাও কোম্পানির কাছে গিয়ে টাকা পাই না। যা হিসাব দেয় তা বুঝে আসে না।

রাইদা বাসের কোম্পানি স্টাফ ইয়াসিন বলেন, ‘বাস স্টাফদের বেতন ধরলেও তারা চিন্তা করে- ট্রিপে দৈনিক একটা খরচ আছে, ওইটা উঠাইতে হবে। তাদের ট্রিপপ্রতি এক হাজার টাকা ধরা হইছে, এর মধ্যে ড্রাইভার ৬০০ টাকা, হেল্পার ৪০০ টাকা। এখন কম কইরা হইলেও ৩ ট্রিপ দেওয়া যায়। তাহলে মোটামুটি একটা টাকা তারা পায়। কিন্তু তারা চিন্তা করে সকালে আর সন্ধ্যায় দুই ট্রিপেই যত কামানো যায়। আবার কোনও কোনও কোম্পানির বাস সারা দিন তিন-চারটা ট্রিপ দেয়। তাহলে আরও টাকা। মালিকরে কিন্তু তারা বেশি আয় করলে বেশি টাকা দেয় না। উল্টা নানা বাহানায় কম দেওয়ার চিন্তা করে। বেশিটা তারাই রেখে দেয়। এই যে কাঁচা টাকার খেলা- এইটাই তো তারা ছাড়তে চায় না।’

মিরপুরের শিকড় পরিবহনের এমডি মো. শাহজালাল বলেন, “আমরা নামে মালিক, আসল মালিক তো চালক-হেল্পাররা। তাদের আমরা কী আয়ের ব্যবস্থা করবো। তারাই সারা দিন পর এসে আমাদের বেতন দেয়। মালিকরা তো শুধু বাস নিয়া ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায় নামছে, এইটার আয় এনে দেয় চালকরা। আর আয়ের বিষয়টা চালকদের কাছে থাকায় তাদের কিছু বলাও যায় না। যেমনে ইচ্ছা গাড়ি চালায়, মামলা খায়, এইটা-ওইটা নষ্ট করে গাড়ির। আর এইসব ঝুটঝামেলা নিতে হয় মালিকদের।”

যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে : কাউন্টার ব্যবস্থায় আগ্রহ দেখালেও বাসচালক ও শ্রমিকদের অনাগ্রহের কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা। নতুন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে বাসচালকরা গাড়ি রাস্তায় নামাচ্ছেন না। যত্রতত্র যাত্রী তুলে কাউন্টারে বাস পূর্ণ করে নিয়ে আসেন। এতে যারা টিকিট কেটে বাসে ওঠার জন্য অপেক্ষা করেন, তারা উঠতে পারেন না।

রামপুরার এক যাত্রী মোতাহার হোসেন বলেন, ‘এই ব্যবস্থা চালুর পর মনে হয়েছে পরিবহন খাতেও শৃঙ্খলা আসছে। যদিও বাসগুলো ভালো ছিল না, তবু শৃঙ্খলা আসছে দেখে ভালো লাগছিল। কিন্তু এখন দেখি ঝামেলা বেড়েছে, বাস তো পাওয়াই যায় না। যেগুলো আসে, সব বাস যাত্রী ভরে নিয়ে আসে। বেশিরভাগ যাত্রী রাস্তা থেকে ওঠায়। আমরা টিকিট কেটে উল্টো ভোগান্তিতে পড়ি।’

যা বলছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি : ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, কয়েকটি বাস কোম্পানির নিজেদের মধ্যে অনিয়ম ছিল, ঝামেলা ছিল। তাই সব কাউন্টার বসাতে পারে নাই। আবার বাস ড্রাইভার-হেল্পাররাও চাচ্ছে না শৃঙ্খলা অনুযায়ী চলুক। তারা চায় চুক্তিতে বাস চালিয়ে তিন হাজার মালিককে দিয়ে নিজেরা ৯ হাজার টাকা রাখতে। তাই বিশৃঙ্খলা থাকলেও তারা আগের মতোই চলতে চায়। শুধু তারাই নয়, যেসব বাসচালক-হেল্পার নিয়মের মধ্যে আসতে চাচ্ছেন, তাদেরও বাধা দিচ্ছে।

সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা যতটা সহজ দেখা যায়, ততটা সহজ না। আমাদের আরও কয়েক মাস লাগবে। ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশনের বাসস্ট্যান্ডগুলো থেকে পুলিশকে নিয়ে অস্থায়ী পার্কিং উচ্ছেদ করেছি। আর যেসব রুটের বাস স্টাফদের মজুরি নিয়ে ঝামেলা, সেটাও সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। তারপরও কেউ কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু যারা নিয়মের মধ্যে না আসবে তাদের বাস বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই বিষয়ে আমরা ও পুলিশ প্রশাসন শক্ত আছি।

সুবিধাভোগী গোষ্ঠীও চাচ্ছে না গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসুক মন্তব্য করে সাইফুল আলম বলেন, কিছু কিছু কোম্পানির লোক আছে, যারা অনিয়মে চললে সুবিধা পায়। একটা কোম্পানি চালাতে যদি পাঁচ লাখ টাকা লাগে সেখানে তারা বিশ লাখ টাকা উঠায়। বাকিটা নিজেরা রেখে দেয়। সিস্টেমের মধ্যে থাকলে তো এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, ফাঁস হয়ে যাবে। তাই তারা উসকানি দেয় চালকদের। আবার চাঁদাবাজদেরও সমস্যা। কাউন্টারের মাধ্যমে বাস চললে টাকা তো বাস স্টাফদের কাছে থাকবে না। তখন তারা কার কাছ থেকে চাঁদা নেবে। তাই তারাও চালকদের সঙ্গে মিলে এই কাজে বাধা দিচ্ছে।

সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে : গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও এটি এখন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালক-শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এ ধরনের পরিবর্তন কার্যকর করা কঠিন। মালিক-শ্রমিকদের বিরোধ এবং নীতিনির্ধারকদের দুর্বল পরিকল্পনার কারণে যাত্রী দুর্ভোগ কমার কোনও ইঙ্গিত এখনও দেখা যাচ্ছে না।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘সরকার যদি গণপরিবহন খাতকে নিজেদের আওতায় এনে একটি কোম্পানি পরিচালনা করে, তবে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব। মেট্রোরেলের মতো একটি পরিবহন ব্যবস্থার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা খুব বেশি নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কোম্পানিটিকে একটি লাভবান ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে পারলে পরিবহন ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.