তাজুল ইসলাম নয়ন॥ শৈশব থেকে কৌশর এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি আর শেখ কামাল একসঙ্গে ছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্য ৭৫এর ১৫ই আগষ্ট ঘাতকের নির্মমতায় হারালাম শেখ কামালসহ পুরো পরিবার। বঙ্গবন্ধুর জৈষ্ঠ্য সন্তান শেখ কামাল আমার সাথে ১৯৫৬ সালে ডনস্ কিন্ডার গার্টেন স্কুলে পড়ত। সেই শৈশব থেকে তার সাথে আমার একটা বন্ধুত্ব তৈরী হয়। ১৯৬১ সাল পযন্ত আমরা দুজনে ডনস্ কিন্ডার গার্টেন স্কুলে পড়ি। আমরা তখন ক্লাস থ্রি থেকে ক্লাস ফোর এ উঠেছি। সেই সময় জুন মাসে ফাইনাল পরীক্ষা হতো। মাঝখানে এমন দুই তিন বছর চলে তারপর আবার ডিসেম্বর মাসে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়।
ঐ সময় আমি গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য ভর্তি পরিক্ষা দেয় এবং উত্তির্ণ হয়ে ভর্তি হয়। আর ঐ বছরই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় শেখ কামাল সাহিন স্কুলে ৫ম শ্রেনীতে ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষা দেয় এবং উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়। সে সাহিন স্কুলে আর আমি ল্যাবরেটরিতে। কা¬স ফাইব থেকে এস এস সি পর্যন্ত আমি ল্যাবরেটরিতে পরি এবং এস এস সি পাস করি আর শেখ কামার সাহিন স্কুল থেকে এস এস সি পাস করে। ১৯৬৭ সালে দুজনেই আবার ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। আমাদের পুরোনো বন্ধুত্বের বন্ধন আরো ঘনিষ্ট হয়। তারপর ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে কামালের বিশেষ বিশেষ ভুমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুর মতই সে বড় নেতা ছিল। সে তার বন্ধুদের এবং সহপাঠিদের এমনকি কলেজের সকল শ্রেণীর ছাত্রদের আকর্ষন করতে পারত। তার সেই আকর্ষন করার মত বিশেষ ক্ষমতা ছিল। সহজ সরল এবং খুবই সাধারভাবে চলাফেরা করত। সে যে বঙ্গবন্ধুর সন্তান এটা কাউকে বোঝাত না এমনকি তার চলাফেরাই তা প্রকাশ করত না।
সে সহজ সরল ছিল এবং তার চরিত্রে অনেক বৈশিষ্ট ছিল। সে খেলধুলা করত; কালচারাল সাইডে তার একটা বিশেষ ভুমিকা ছিল। ৬৯এর পর আবার আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমার্স ভবনে ভর্তি হয় এবং শেখ কামাল আর্টস্্ ডিপার্টমেন্টে স্যুসোলজিতে ভর্তি হয়। স্যুসোলজি ছিল নীচ তলায় তার ঠিক উপরে তিন তলায় ছিল আমাদের কমার্স ডিপার্টমেন্ট। প্রতিদিনই দেখা সাক্ষাৎ, গল্প গুজব, টি এস সিতে আসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায়, ওদের কমন রুমে আলোচনা ও কথাবার্ত হত। শেখ কামালের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, সে যে কোন মানুষেরই কথাবার্তা মনযোগ দিয়ে শুনতেন। তারপর ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ কামালের দেখা হয়নি। কারন আমি এলাঘরে ট্রেনিং নিই; আর সে আর্মিতে যোগ দেয় ফাষ্ট কমিশন রেঙ্কে। যোগদানের পরে কমিশন লাভ করে এবং পরে সে উসমানী সাহেবের এডিসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭৫ পর্যন্ত দুজনের প্রতিদিনই যোগাযোগ ছিল। আমি তখন রাজনীতি করতাম আর সেই কারণে তার সঙ্গে যোগাযোগ আরো বেশী হত। সকল বিষয়েই আমাদের দুজনের আলাপ আলোচনা হত। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট আমরা বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসিপশন দেয়ার কথা ছিল। এই রিসিপশনের জন্য অনেক খাটা খাটনি করি। যেদিন বঙ্গবন্ধু শহীদ হন সেদিন রাতে রিসিপশনের কাজ শেষ করে আনুমানিক রাত ১২.৪৫ (পোনে একটার) দিকে আমি বাসায় ফিরি। পরদিন সকাল বেলা ৬.৩০ দিকে আমার আব্বা আমাকে ডেকে উঠায় এবং বলে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। তখন আমি হতাশ হয়ে যায় এবং কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপর আরো শুনলাম শেখ কামাল, শেখ জামাল, বঙ্গবুন্ধুর স্ত্রী এমনকি ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলকেও তারা মেরে ফেলেছে। তখন আমি আস্তে আস্তে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে যাওয়া শুরু করি এবং বাসার কাছাকাছি গেলে লোকজন আমাকে বলে আপনি আর সামনে যাইয়েন না; ওখানে আর্মি আছে আর অনেকেই আপনাকে চিনে। তখন আমি ফিরে আসি। সারাক্ষণই আমার মনে সেই স্মৃতিগুলি ভাসে। শেখ কামালের কথা মনে পড়ে, কত সুন্দর সময় পার করেছি। অনেক হাসির খোরাছ যে যুগিয়েছিল। সে কৌতুক পছন্দ করত। একবন্ধু ছিল বাধন সেই আমাদের সঙ্গে থাকত এবং অনেক মজা করতাম। বাধনও শেখ কামালের অনেক ঘটিষ্ঠ ছিল। আমিতো এই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। এখন আমি শেখ কামালের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ যেন শেখ কামাল এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকে বেহেস্তের সর্বোচ্চ এবং ভাল জায়গায় স্থান দেন। আমি সব সময়ই এই কামনা করি।
এতক্ষণ শুনলাম শেখ কামালের ঘনিষ্ট বন্ধুর কথা। কি ছিলনা শেখ কামালের মধ্যে। তারপরও ষড়যন্ত্রকারীরা ঐ নিস্কলুষ মানুষটিকে কতইনা মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। তবে কালের পরিক্রমাই আজ স্পষ্ট সকল ষড়যন্ত্র এবং মানুষ সত্যকে জানতে পেরেছে এবং মিথ্যাবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হয়েছে। আমরা যা হারিয়েছি তা হয়ত পাব না কিন্তু তাঁরা যা দিয়ে গেছে সেই অমূল্য সম্পদকে আঁকড়ে ধরে ও পুজি করে প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। সকল মিথ্যা, অপবাধ এবং কুসংস্কারকে এই বাংলার মাটি থেকে চিরতরে বিতারিত করে ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।