মিজানুর রহমান খান॥ প্রধান বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে সাংসদদের নয়, বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অপরিপক্ব বলেছেন। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রসঙ্গ সর্বাধিকবার ব্যবহার করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
রায়ের নিবিড় পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর রায়ে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকেই চিত্রিত করেছেন। ষোড়শ সংশোধনীর ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে দেখা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে মোট ১১ বার এসেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক পাঁচবারই উল্লেখিত হয়েছে প্রধান বিচারপতির অংশে। বঙ্গবন্ধু শব্দটি মোট এসেছে নয়বার। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি একাই উল্লেখ করেছেন তিনবার (পৃষ্ঠা ৩০, ১৪০ ও ২২৬)। তিনি ৩০, ৫৪ ও ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।
স্বাধীনতা ও স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রসঙ্গ এবং বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে অন্যরাও তাঁদের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে শুধু প্রধান বিচারপতিই জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদকে অবৈধভাবে ক্ষমতা জবরদখলকারী এবং ব্যানানা রিপাবলিকের উদ্গাতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিএনপি অবশ্য এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত রয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল তাঁর নিবেদনে বাহাত্তরের বাংলাদেশ গণপরিষদে ড. কামাল হোসেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, আসাদুজ্জামান খান, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদের দেওয়া বক্তৃতাও তুলে ধরেন। পূর্ণ রায়ে দেখা যায়, প্রধান বিচারপতি ছাড়াও রায়দানকারী অন্য ছয় বিচারপতির পর্যবেক্ষণেই স্বাধীনতার প্রসঙ্গ এসেছে ব্যাপকভাবে। রায়ে স্বাধীনতা (লিবারেশন ইতিবাচক অর্থে) কথাটি মোট এসেছে ৩২ বার। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতির লেখা ৩৯৪ পৃষ্ঠার রায়ে এসেছে ২১ বার। তাঁর রায়ের প্রথম ৬৪ পৃষ্ঠার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ‘ইন্ডিপেনডেন্স’ শব্দটি এসেছে ১২ বার।
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে বাংলাদেশের ‘ফাউন্ডারস’ বা প্রতিষ্ঠাতাগণ শব্দটি এসেছে মোট ১২ বার। এর মধ্যে ১১ বার ব্যবহার করেছেন প্রধান বিচারপতি। এ ছাড়া তিনিই এককভাবে তাঁর রায়ে পাঁচবার ফাউন্ডিং ফাদার্স কথাটি ব্যবহার করেছেন। প্রতীয়মান হয় যে তিনি ফাউন্ডার্স এবং ফাউন্ডিং ফাদার্স বলতে গণপরিষদের সদস্যদের বুঝিয়েছেন।
প্রধান বিচারপতি রায়ের ২৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ইয়াহিয়া শেষ পর্যন্ত সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করেন এবং নিরস্ত্র বাঙালির ওপর তিনি দমন অভিযান চালান, যার প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ দেন এবং তারপর থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক উল্লেখ করেন।
৬১ পৃষ্ঠায় তিনি বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় থাকা ‘আমরা’ কথাটির উৎপত্তি সম্পর্কে লিখেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু কতিপয় ধর্মীয় উগ্রপন্থী এবং তাদের অশুভ সহযোগী ব্যতিরেকে তাঁতি, মজুর, শিক্ষক, পুলিশ, আর্মি, আনসার, বিডিআর, অন্য সব রাজনৈতিক দলসহ সর্বস্তরের জনগণ এতে অংশ নিয়েছিল।
প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ‘আমরা যদি সতর্কতার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের দর্শনের দিকে নজর দেই তাহলে দেখব, “আমরা বাংলাদেশের জনগণ” থেকেই আমাদের সব মৌলিক চিন্তাভাবনা বিকশিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি তার মূলে রয়েছে এই “আমরাবাদ” (উইনেস) প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এখন আমরা অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পড়ে এই আমরাবাদকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছি।’
এরপরই তিনি সেই মন্তব্য করেন, যা এখন বিতর্কের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘কোনো জাতি বা দেশ কোনো এক ব্যক্তিকে দিয়ে গড়ে ওঠে না, কিংবা কোনো একজন দ্বারা তা গঠিতও হয় না। আমরা যদি সত্যিই জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে আমিত্বের আসক্তি এবং এই আত্মঘাতী অভিপ্রায় থেকে মুক্ত হতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি তাঁর পর্যবেক্ষণে সাংসদদের নয়, বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অপরিপক্ব বলেছেন। প্রধান বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী মামলায় হািইকোর্টের রায়ের পর সংসদে বিচারকদের সমালোচনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে মন্তব্য করেছেন: ‘সংসদের ফ্লোরে রায়ের সমালোচনা হয়েছে অসংসদীয় ভাষায়। এটা প্রমাণ করে যে, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব এবং পরিপক্বতা অর্জন করতে হলে ধারাবাহিকভাবে অন্তত ৪/৫ মেয়াদে সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলন করার প্রয়োজন রয়েছে।’ কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি সংসদ বা সাংসদদের ‘অপরিপক্ব’ বলেছেন।
নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন হলো, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষভাবে এবং কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে না হতে পারে তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অভাবে একটি গ্রহণযোগ্য সংসদ গঠিত হতে পারে না। এর ফল হিসেবে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং সংসদ শিশু অবস্থায় রয়ে গেছে। জনগণ এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না এবং এসব প্রতিষ্ঠান যদি জনগণের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জনে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ না ঘটাতে পারে, তাহলে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাবে সংসদ জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হতে পারে না। এর ফলে সংসদের নিজেরই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বাধাগ্রস্থ হতে পারে। আর যদি সংসদ যথেষ্ট পরিপক্ব না হয়, তাহলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা তাকে দেওয়া হবে আত্মঘাতী।’
প্রধান বিচারপতির অতীতের আরও কয়েকটি মামলার রায়েও দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মাস্টারপিস’ অভিহিত করেছিলেন। তিনি যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মামলার রায়ে প্রথম ১৪ পৃষ্ঠায় ২৪ বার বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছিলেন। যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার রায়েও তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন।
প্রশ্ন হল, এই রায় নিয়ে বিএনপি খুশীতে নাচতেছে কেনো ? আর আওয়ামী লীগের দায়ীত্বশীল মন্ত্রী: আবুল মাল আব্দুল মুহিত, এড.কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসীম ও আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাসান মাহমুদ এর বক্তব্য এতটা বেফাঁস কেনো ? তবে, আমাদের আস্থা ও ভরসাস্থল মাননীয় আইনমন্ত্রী এড. আনিসুল হকের বক্তব্য ছিল মার্জিত, দায়ীত্বশীল, গঠনমূলক, প্রাসঙ্গিক ও অনেক পরিপক্ক। ধন্যবাদ প্রিয় নেতা আনিসুল হক।