বাআ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকারকারীদের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশে কিছু লোক আছেন যারা সব সময়ই জাতির সামনে বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরার অপচেষ্টা চালান। তিনি বলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ২১টি বছর বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালানো হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলেন, কোন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টায় দেশ স্বাধীন হয়নি। কিন্তু যার একক উদ্যোগ, প্রেরণা এবং সাংগঠনিক শক্তি এর নেপথ্যে ছিল তিনি হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর একক অবদান অস্বীকার করে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ সত্যটি যারা উপলদ্ধি করতে পারবে না তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আদৌ বিশ্বাস করে কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রাতে গণভবনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদক মন্ডলীর যৌথ সভার সূচনা ভাষণে একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘সেই স্বাধীনতা বিরোধীরা, যারা মুক্তিযুদ্ধ চায়নি, গণহত্যায় জড়িত, এদেশে লুটপাট, নারী ধর্ষণ, নৃশংসতার সাথে জড়িত তাদের প্রেতাত্মা এখনও বাংলাদেশে রয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, জাতির দুর্ভাগ্য যে, যারাই এ জাতির ভাগ্য পরিবর্তন এবং মুখে হাসি ফোটাবার জন্য কাজ করে, যখনই মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করে তখনই ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সুযোগ পেলেই তারা ছোবল মারার চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদেরকে বুঝতে হবে যে, কারা তাদের মঙ্গল ও কল্যাণ করে এবং তাদের উন্নয়নে কাজ করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই তাদের মূল্যায়ন এবং জনগণের কল্যাণ হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা জাতির পিতাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিল তারা স্বাধীনতা বিরোধীদেরকেই ক্ষমতায় বসিয়েছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না তাদের নিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছিল। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বেতারের নাম পাকিস্তানী স্টাইলে রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেল। এভাবে ’৭৫-এর পর বাংলাদেশের নামটাও পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি আগেই বলেছি ইতিহাসকে কেউ চাপা দিয়ে রাখতে পারে না। ইতিহাস কখনও চাপা থাকে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু করে। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে জাতির পিতা একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নের পথে যাত্রাও শুরু করেছিলেন। যদি ১৫ই আগস্টের মতো কালো দিবস বাঙালি জাতির জীবনে না আসতো তাহলে স্বাধীনতা অর্জনের ১০ কছরের মধ্যেই বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতো। আর এটা যে করা যায় তাতো আমরা দেখেছি, মাত্র সাড়ে ৩ বছরে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ তিনি কিভাবে গড়ে তুললেন।
তিনি বলেন, আজকে সরকার চালাতে গিয়ে দেখি যেখানেই আমরা হাত দেই, প্রত্যেকটা আইন, সবকিছু তিনিই করে দিয়ে গেছেন। এতো অল্প সময়ের মধ্যেও এমন কোন কাজ বাকী নেই যেটা তিনি করেননি।
শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু দেশটা স্বাধীন করলেন তাই সেই চিন্তা চেতনা সবসময়ই তাঁর মাঝে ছিলো। সেজন্য তাঁর প্রস্তুতিও ছিল। পাকিস্তানের একটা প্রদেশ, সবচেয়ে শোষিত, বঞ্চিত একটা ভূখন্ড, সেই প্রদেশকে একটা রাষ্ট্রে উন্নীত করা, একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা-মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে-এত সহজ কাজ ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার মতো নেতৃত্ব ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই সত্য প্রকাশিত হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সত্যকে যে যতই মুছতে চেষ্টা করুক সত্যটা একদিন উদ্ভাসিত হবেই।
তিনি বলেন, যারা দু’বেলা দুমুঠো খেতে পারত না, অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে বাস করতো, ৯০-৯৯ ভাগ লোকই দরিদ্র ছিল, কোনরকম দিন এনে দিন খায়, বিদেশ থেকে পুরনো মোটা কাপড় এনে যাদেরকে পড়তে দেয়া হত, রোগে ধুঁকে ধুঁকে মারা যেত, চিকিৎসা পেত না, এরকম একটি জাতিকে জাতির পিতা স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় এনে দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোনই অবকাশ নেই উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, পাকিস্তানী বাহিনী ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর আক্রমণ চালানোর পরপরই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানীরা ধানমন্ডী ৩২ নম্বরে জাতির পিতার বাড়ি আক্রমণ করে এবং তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন তাতে বঙ্গবন্ধুকেই দোষারোপ করেন। ইয়াহিয়া বলেন, তাঁর বিচার হবে এবং তাঁকেই পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া খান তাঁর ভাষণে আর কারো নাম বলেননি বা কাউকে দোষারোপ করেননি। মানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়াটা যেন বড় অপরাধ ছিল। আর সেই অপরাধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অপরাধী করেছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। জিয়াউর রহমানতো তার চাকরী করতো। একজন মেজর ছিল সেনাবাহিনীর। তাকে কি গ্রেফতার করেছিল বা তার কি চাকরী খেয়েছিল? তাও খায়নি বা এরকম আরো অনেকেই ছিল। কিন্তু, বঙ্গবন্ধুকেই তারা শত্রু হিসেবে দেখেছিল। তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং প্রহসনের বিচার করে ফাঁসির রায়ে সই পর্যন্ত করেছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, সেই ইতিহাস বিকৃত করে আরেকজনকে ঘোষক বানিয়ে দেয়া হলো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘোষক কাকে করেছিলো- যে সেনা কর্মকর্তাকে ধরে এনে আওয়ামী লীগ এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র ঘোষণা পাঠ করায়। তাকেই ঘোষক বানিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াবার চেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, জাতির পিতার নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর মোকাবেলা করা, যারা তখন সমস্ত রাস্তা-ঘাট সবকিছু অচল করার জন্য বেরিকেড দিতে শুরু করেছিল এবং চট্টগ্রামেই যারা বেরিকেড দিয়েছিল পাকিস্তানী শাসকদের পক্ষ হয়ে জিয়াউর রহমান তাদের ওপর গুলি চালিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামরত মানুষকে হত্যা করেছিল।
তিনি বলেন, ২৭ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বারবার প্রচার করা হচ্ছিল তখন জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতা। তিনি বলেছিলেন এটা যেহেতু যুদ্ধ তাই সেনাবাহিনীর কাউকে নিয়ে এলে তাকে দিয়ে ঘোষণা করালে যুদ্ধ যুদ্ধ মনে হবে। কারণ ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান সহ আরো অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা তখন পর্যন্ত পাঠ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র নামাতে গেলে আমাদের ভলান্টিয়াররা তাকে বেরিকেড দেয় এবং আটকায়।