জসীমউদ্দীন ইতি ॥ ইতিহাস সমৃদ্ধ এই জনপদটিতে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার বহু মূল্যবান সম্পদ। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে প্রাচীন জনপদ পঞ্চগড় ও সংলগ্ন এলাকায়। অবসরে ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে। একটি শহরকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে উপাদান প্রয়োজন তার সবই পঞ্চগড় জেলায় বিদ্যমান। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে পঞ্চগড় হতে পারে এক অসাধারণ জায়গা।
ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ মহারাজার দিঘী, চা বাগান, শাহী মসজিদ, ভিতরগড়, মিরগড়, রকস মিউজিয়াম, জিরো পয়েন্ট, মহানন্দা নদী, বারো আউলিয়া মাজার ইত্যাদি।
ভারতীয় উপমহাদেশে ‘পঞ্চ’ শব্দটি বিভিন্ন স্থানের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে। যেমন- পঞ্চনদ, পঞ্চবটি, পঞ্চনগরী পঞ্চগৌড় ইত্যাদি। সুতরাং পঞ্চগৌড়ের একটি অংশ হিসেবে প্রাকৃত ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পঞ্চগড়ের নামকরণ হতে পারে। এই অঞ্চলের পাঁচটি গড়ের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি।
কাঞ্চনজঙ্ঘা
পঞ্চগড়ের প্রায় সব জায়গা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলেও সবচেয়ে ভালো করে উপভোগ করা যায় তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা নদীর তীরে জেলা পরিষদের ঐতিহাসিক ডাকবাংলো থেকে।
ভোরের আলো ফুটতেই তা গিয়ে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায়। চারপাশে তখনও আবছা অন্ধকার থাকলেও চকচক করে পর্বত চূড়াটি। সূর্যের আলোর সঙ্গে কখনো শুভ্র, কখনো গোলাপি, কখনোবা লাল রং নিয়ে হাজির হয় বরফে আচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাসপোর্ট-ভিসা করে ভারত বা নেপালে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সুযোগ নেই অনেকেরই।
তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোহর দৃশ্য দেখার সুযোগ মিলছে বাংলাদেশ থেকেই। দেশের একমাত্র ‘হিমালয়কন্যা’ পঞ্চগড়ে সবুজ মাঠের পাশে ভেসে উঠছে ছবির মতো সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই সঙ্গে দেখা মিলছে ছায়ার মতো দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলেরও। পঞ্চগড়ে হালকা এই শীতের সময়ই কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দর্শনের সবচেয়ে ভালো সময়।
এখন অনেক পর্যটক পঞ্চগড়ে ছুটে আসছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্ব শ্রেণি হিমালয়ের দ্বিতীয় উচ্চতম ও পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য উপভোগ করতে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসন একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসনও নিয়েছে নানা ব্যবস্থা। পঞ্চগড়ের প্রায় সব জায়গা থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলেও সবচেয়ে ভালো করে উপভোগ করা যায় তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা নদীর তীরে জেলা পরিষদের ঐতিহাসিক ডাকবাংলো থেকে।
নদীর ওপারেই ভারত। ভারতের সিকিম রাজ্য ও নেপালে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। পঞ্চগড়ে প্রতিবছর হেমন্ত ও শীতকালের শুরুতে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) কাঞ্চনজঙ্ঘা সবচেয়ে ভালো দেখা গেলেও তাতে প্রকৃতি কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শর্ত হলো—মেঘ ও কুয়াশামুক্ত গাঢ় নীল আকাশ। এমন আবহাওয়াতেই পঞ্চগড়ে চমৎকারভাবে ভেসে ওঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
স্থানীয় লোকজন জানান, হালকা শীতে পরিষ্কার আকাশে উত্তরে চোখ মেললেই দেখতে পাবেন খোলা মাঠের ফাঁক দিয়ে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘার বিস্ময়কর সৌন্দর্য উপভোগ করতে শীত এলেই পঞ্চগড়ে ছুটে আসেন
সরেজমিনে দেখা যায়, তেঁতুলিয়া উপজেলার ঐতিহাসিক ডাকবাংলোতে অনেক পর্যটকের ভিড়। তাঁরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পঞ্চগড়ে ঘুরতে এসেছেন। মহানন্দা নদীর এপার থেকেই তাঁরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য উপভোগ করছেন। কেউবা পর্বত চূড়ার সঙ্গে নিজেকে ছবিবন্দি করছেন।
কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করার মোক্ষম সময় ভোর এবং বিকেল বেলা। এ সময়ের আলোয় পর্বত চূড়াটি পোড়ামাটির রং নেয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ঝাপসা হয়ে আসে। তখন রং হয় সাদা। দূর থেকে মনে হয় এটি আকাশের গায়ে এক খণ্ড বরফ। পর্বত চূড়াটির নিচ দিয়েই কালো রঙে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি এলাকা দেখা যায়। সন্ধ্যায় দার্জিলিংয়ের জ্বলে ওঠা বাতিগুলোও এখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায়।
এ ছাড়া পঞ্চগড়ের নানা পর্যটনকেন্দ্র প্রকৃতিপ্রেমীদের বাড়তি খোরাক জোগায়। পুণ্ড্র, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম শাসনামলের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জনপদ। এখানে রয়েছে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্ত বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, জিরো পয়েন্টের জয়েন্ট রিট্রিট সেরিমনি, সমতল ভূমির চা বাগান, মুঘল স্থাপনা মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বোদেশ্বরী পীঠ মন্দির, দেড় হাজার বছরের পুরনো মহারাজা দিঘি, ভিতরগড় দুর্গনগরী ও দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর পঞ্চগড়ের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফলে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে কদর বাড়ছে পঞ্চগড়ের।

ঐতিহাসিক বার আউলিয়া মাজারে এক দিনের বার্ষিক উরস এর ছবি,বার আউলিয়া মাজার শরীফ
আরেক প্রাচীন স্থান সুফী সাধকের বারো আউলিয়া মাজার পঞ্চগড়ের আটোয়ারিতেই। বার আউলিয়াদের আগমনের ইতিহাস বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেলেও ওলীদের ইতিহাস রহস্যাবৃত্ত।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ১২ জন সুফি সাধক এখানে এসে বসবাসের পর থেকেই জায়গাটি বারো আউলিয়া নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। সুলতানি আমলে ১২ জন ওলী খাজাবাবার নির্দেশে চট্রগ্রামসহ পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থান গড়ে তুলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। পরে স্থল পথে রওয়ানা হয়ে ইসলাম প্রচার করতে করতে উত্তরবঙ্গের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছান এবং মির্জাপুর ইউনিয়নের বারো আউলিয়ায় আস্তানা গড়ে তুলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
আটোয়ারির মাটিকে পূর্ণ ভূমিতে পরিণত করার পর সময়ের বিবর্তনে ওলীদের এখানেই সমাহিত করা হয়। গড়ে উঠে বারো আউলিয়ার মাজার শরীফ। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার বারো আউলিয়ার মাজার প্রাঙ্গণে ওরসের অয়োজন করা হয়। ভক্তরা মানতের টাকা-পয়সা, ধান-চাল, মুরগি-কবুতর ও গরু-ছাগল দান করেন।

পাথরের জাদুঘর (রকস মিউজিয়াম)
দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর পঞ্চগড়ে। পাথরের জাদুঘরটি ‘রকস মিউজিয়াম’ নামেই পরিচিত। সরকারি মহিলা কলেজে ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ পাথরের জাদুঘরে রয়েছে নতুন এবং পুরনো পাথরের রকমারি সমাহার। প্রত্যেকটি পাথরের পাশে লেখা রয়েছে কোথা থেকে আনা হয়েছে এবং কারা সংগ্রহ করেছেন এ মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ।
এখানে রয়েছে আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা, নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, কাঁচবালি, খনিজবালি, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিন শিলাসহ আরও অনেক প্রত্ন সম্পদ। নানান আকৃতির পাথরগুলো হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটিই এশিয়ার একমাত্র পাথরের জাদুঘর।
১৯৯৭ সালে রকস মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠা করেন এই কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হক। এসব প্রাচীন স্থাপনা ছাড়াও অনেক নিদর্শন রয়েছে পঞ্চগড়ে।

ডাক বাংলোয় ঘুরতে গিয়ে যা দেখবেন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার তেঁতুলিয়া ডাক বাংলো। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদীর দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই কল্পনার রাজ্যে ভাসবেন আপনি! মাঝে মাঝে এ ডাক বাংলো থেকে স্পষ্ট দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়। সব মিলিয়ে অভূতপূর্ব দৃশ্য সৃষ্টি হয় স্থানটিতে।
পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে আছে একটি ঐতিহাসিক ডাক বাংলো। এর নির্মাণ কৌশল অনেকটা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের। জানা যায়, কুচবিহারের রাজা এটি নির্মাণ করেছিলেন। ডাক-বাংলোটি জেলা পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত।
এ বাংলোর পাশেই আছে তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ কর্তৃক নির্মিত একটি পিকনিক স্পট। ডাক বাংলো ও পিকনিক স্পট দু’টি স্থানই পাশাপাশি অবস্থিত হওয়ায় স্থানটি পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। সৌন্দর্য বর্ধনে এ স্থান দুটির সম্পর্ক যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষা ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন (অর্থাৎ নদী পার হলেই ভারত) সুউচ্চ গড়ের উপর সাধারণ ভূমি হতে প্রায় ১৫ হতে ২০ মিটার উঁচুতে ডাক-বাংলোটি অবস্থিত। সেখান থেকেই হেমন্ত ও শীতকালে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
অন্যদিকে বর্ষাকালে মহানন্দা নদীতে পানি থাকলে এর দৃশ্য আরও বেশি মনোরম হয়। শীতকালে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য অনেক দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে।

মুক্তাঞ্চল
জেলা শহর থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে সদর উপজেলার অমরখানা এলাকায় পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কের পাশে চাওয়াই নদের ধারে রয়েছে মুক্তাঞ্চল পার্ক। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধমুক্ত থাকা এই এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
স্থানটির স্মৃতি ধরে রাখতে জেলা প্রশাসন সেখানে গড়ে তুলেছে মুক্তাঞ্চল পার্ক। এখানে গেলে পঞ্চগড়ের পাঁচটি গড়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন পর্যটকেরা।

মুঘল আমলের মির্জাপুর শাহী মসজিদ
মির্জাপুর শাহী মসজিদটি পঞ্চগড়ের অটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে অবস্থিত। ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করা হয় বলে জানা যায়, যা ঢাকার হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত মসজিদের সমসাময়িক। ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের মসজিদ ও মির্জাপুর শাহী মসজিদের নির্মাণ শৈলীতে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।
তবে এটি কে নির্মাণ করেছিলেন সে বিষয়ে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেন মির্জাপুর গ্রামেরই এক বাসিন্দা এটি নির্মাণ করেছিলেন। আবার কারো মতে দোস্ত মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি এটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। মসজিদটির মধ্যবর্তী দরজার উপরে একটি ফলক রয়েছে, যেখানে ফার্সি ভাষায় এর নির্মাণ সম্পর্কিত তথ্য লেখা আছে। ফলকের ভাষা ও লিপি অনুযায়ী প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন, মোঘল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদের গায়ে টেরাকোটা ফুল ও লতাপাতার নকশা খোদায় করা আছে, যার একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো সাদৃশ্য নেই। নির্মাণ শৈলীর নিপুণতা, দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য ও তিনটি গম্বুজ এই মসজিদের মূল আকর্ষণ। মসজিদটি এখন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধিনে রয়েছে। বর্তমানে অনেক দর্শনার্থী এ মসজিদ দেখতে আসেন।

গোলকধাম মন্দির
গোলকধাম মন্দিরটি দেবীগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত শালডাংগা ইউনিয়নের শালডাংগা গ্রামে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। সুন্দর কারুকার্যময় এই মন্দিরটির গায়ের শিলালিপি অনুযায়ী জানা যায়, এটি ১৮৪৬ সালে নির্মাণ করা হয়।
মন্দিরটি মূলত গোলক কৃষ্ণ গোস্বামীর স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই মন্দিরের নামেও তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। গোলকধাম মন্দিরটি ছয় কোণ বিশিষ্ট একটি স্থাপনা। এর স্থাপত্য কৌশল গ্রিক পদ্ধতির অনুরূপ, যা এখন বিলুপ্ত প্রায়। তাই এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির
বদেশ্বরী মন্দিরটি বোদা উপজেলায় অবস্থিত। অনেকে বলেন, এই মন্দিরের বদেশ্বরী নাম থেকেই এই উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। আবার কিছু মানুষের ধারণা, এই অঞ্চলে এক সময় অনেক কাদা হতো আর কাদার সমার্থক শব্দ বোদ থেকেই এসেছে বোদা উপজেলার নাম।
হিন্দু পুরাণের স্কন্দ অনুযায়ী, বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের আঘাতে দেবী দুর্গার দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়েছিল। এর মধ্যে দু’টি খণ্ড পড়েছিল বাংলাদেশে; একটি পড়েছিল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডুতে আর অন্যটি পড়েছিল পঞ্চগড় জেলার বদেশ্বরীতে। সেখানেই চারথশ বা পাঁচথশ বছর পূর্বে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। বদেশ্বরীতে অবস্থিত প্রাচীন এই মন্দিরটিই বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির।
মূলত উপমহাদেশের যেখানে যেখানে দেবী দুর্গার শরীরের খণ্ড পড়েছিল সেই জায়গাটিকে পীঠ বলা হয়। মন্দিরের দেওয়ালে ঝুলানো একটি চার্টে এরকম ৫১টি পীঠ স্থানের উল্লেখ রয়েছে। বদেশ্বরীর এই পীঠে এখনো সংরক্ষিত আছে দেবী দুর্গার গোড়ালি।

ভিতরগড় দুর্গ
ভিতরগড় মধ্য যুগের একটি বিশাল দুর্গনগরী। এটি প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, যা বাংলাদেশের সব থেকে বড় দুর্গনগরী। এর কিছু অংশ বাংলাদেশের পঞ্চগড়ে আর কিছু অংশ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত। ভিতরগড় দুর্গের ভেতরে অনেকগুলো প্রত্নস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ প্রত্নস্থলসমূহ খালপাড়া, প্রধানপাড়া, ছোট কামাত, চুমানুপাড়া, কমলাপাড়া, সেনপাড়া, পেশকার পাড়া, জমাদার পাড়া, বড় কামাত, মেহনা ভিটা ও সিপাহি পাড়া গ্রামজুড়ে অবস্থিত। এর মধ্যে দীঘি, মন্দির, রাজবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এছাড়া এখানে বিভিন্ন আসবাবপত্রসহ দেবী মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এর নির্মাণকাল সম্পর্কে অনুমান করেন যে, এটি প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল।

মহারাজার দীঘি
পঞ্চগড়ের মূল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এক সময় পৃথু রাজের রাজপ্রাসাদ ছিল। এর পাশেই এখনো বর্তমান রয়েছে একটি দীঘি, যা মহারাজার দীঘি নামে পরিচিত। রাজা পৃথু এর খননকৃত এই ‘মহারাজার দীঘিটি বিশাল আয়তনের একটি পুকুর বা জলাশয়। পাড়সহ এর আয়তন প্রায় ৮০০*৪০০ গজ। অধিক গভীরতার কারণে দীঘিটির জল অনেক স্বচ্ছ।
পৃথু রাজা এক দিন কীচক নামক এক নিম্ন শ্রেণির লোকের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। তখন তিনি ধর্ম নাশের ভয়ে উক্ত দীঘিতে আত্মহনন করেছিলেন। প্রতিবছর নববর্ষের সময় ‘মহারাজার দীঘি’র পাড়ে মেলা বসে। উক্ত মেলায় মাঝে মাঝে ভারত থেকেও লোক আসতে দেখা যায়। তবে করোনার কারণ এখন আর মেলা বসে না।

চা বাগান
উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে কয়েক দশ ধরেই শুরু হয়ে চা চাষ। সমতলের এইসব চা বাগান এক দিকে যেমন এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে এনেছে নতুন গতি তেমনি এর অপার সৌন্দর্য সম্ভাবনা জাগিয়েছে পর্যটন শিল্পেও। জেলার বিভিন্ন এলাকায় চোখ যে দিকে যায় দেখা মেলে শুধু সবুজ চায়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। এই দৃশ্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন পর্যটকরা।
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি এখন ভরে গেছে চায়ের সবুজ পাতায়। চা চাষে অর্থনৈতিক উন্নয়নে তৈরি করেছে নতুন দিগন্তের সূচনা।
চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে পঞ্চগড়ে ২ হাজার ২৫৫ দশমিক ৫৫ একর জমিতে সম্প্রসারিত হয়েছে চা চাষ। অনেকে আবার চা বাগানে আম, আমলকি, মেহগনি ও সুপারি গাছ লাগিয়েছে দেখা যায়। গাছগুলো বাগানের অন্য মাত্রার সৌন্দর্য যোগ করেছে। রওশনপুরের জেমকন গ্রুপের কাজী এন্ড কাজীর টি এস্টেটে আনন্দধারা রিসোর্ট। পর্যটন শিল্পের এ দর্শনীয় স্থানটি পর্যটকদের টানছে বারবার।

মিরগড়
যে ৫টি গড় নিয়ে ‘পঞ্চগড়’-এর নামকরণ করা হয়েছে তার মধ্যে মিরগড় অন্যতম। এই গড়টির অধিকাংশ অংশই এখন ভারতের মধ্যে চলে গেছে।

বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট
হিমালয়ের কো’লঘেঁষে বাংলাদেশের সর্বোত্তরের উপজেলা তেঁতুলিয়া। এই উপজেলার ১নং বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে অবস্থিত বাংলাদেশ মানচিত্রের সর্বোত্তরের স্থান বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর। এই স্থানে মহানন্দা নদীর তীর ও ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় ১০ একর জমিতে ১৯৯৭ সালে নির্মিত হয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, নেপালের সাথে বাংলাদেশের পণ্য বিনিময়ও সম্পাদিত হয় বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্টে। সম্প্রতি এ বন্দরের মাধ্যমে ভারতের সাথে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটানের সাথেও এ বন্দরের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র স্থলবন্দর যার মাধ্যমে তিনটি দেশের সাথে সুদৃঢ় যোগাযোগ গড়ে উঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বর্তমান ভারতের সাথে ইমিগ্রেশন চালু হয়েছে। চালু হওয়ার পর থেকে পঞ্চগড় জেলা পর্যটকদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
পরিবহন সেবা
আন্তঃনগর ট্রেনসমূহ:
- একতা এক্সপ্রেস (ট্রেন নং ৭০৫): প্রতিদিন (সাপ্তাহিক বন্ধ: নেই) সকাল ১০:১৫ মিনিটে ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় এবং পঞ্চগড় পৌঁছায় রাত ০৯:০০ মিনিটে।
- দ্রুতযান এক্সপ্রেস (ট্রেন নং ৭৫৭): প্রতিদিন (সাপ্তাহিক বন্ধ: নেই) রাত ০৮:৪৫ মিনিটে ঢাকা থেকে ছেড়ে যায় এবং পঞ্চগড় পৌঁছায় সকাল ০৭:১০ মিনিটে।
- পঞ্চগড় এক্সপ্রেস (ট্রেন নং ৭৯৩): প্রতিদিন (সাপ্তাহিক বন্ধ: নেই) রাত ১১:৩০ মিনিটে ঢাকা থেকে ছেড়ে যায় এবং পঞ্চগড় পৌঁছায় সকাল ০৯:৫০ মিনিটে
বাস সার্ভিস:
হানিফ এন্টারপ্রাইজ:
ঢাকা থেকে পঞ্চগড় রুটে বাস সার্ভিস পরিচালনা করে।
শ্যামলী পরিবহন:
এই পরিবহন কোম্পানিও ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে বাস সেবা দিয়ে থাকে।
নর্থবেঙ্গল:
ঢাকা থেকে পঞ্চগড় পর্যন্ত তাদের বাস চলাচল করে।
এসআর ট্রাভেলস:
পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় যাতায়াতের জন্য এসআর ট্রাভেলস একটি পরিচিত নাম।
নাবিল পরিবহন:
এই পরিবহন সংস্থা ঢাকা, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়সহ অন্যান্য রুটে সার্ভিস প্রদান করে।
ইকবাল এসি বাস:
বাংলাদেশের সেরা এসি বাস সার্ভিসগুলির মধ্যে এটি একটি।
কোথা থেকে বাস ছাড়ে:
ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে পঞ্চগড়গামী বাসগুলো ছাড়ে।
ভ্রমণের সময় ও ভাড়া:
এই রুটে ভ্রমণের সময় প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা লাগে।
ভাড়া সাধারণত নন-এসি বা এসি বাসের উপর নির্ভর করে, যা বাস ভেদে ভিন্ন হতে পারে।
টিকিট বুকিং:
আপনি সরাসরি বাস কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইট বা কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে পারেন।
পঞ্চগড়ে বর্তমানে কোনো আন্তর্জাতিক বা অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর নেই, যার কারণে সরাসরি বিমানে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে, ঢাকা থেকে নিকটস্থ বিমানবন্দর ব্যবহার করে সড়কপথে পঞ্চগড় পৌঁছানোর জন্য বেশ কয়েকটি বিকল্প উপায় রয়েছে।
আকাশপথ
পঞ্চগড়ে দ্রুত এবং সহজে পৌঁছানোর জন্য আকাশপথ এখন জনপ্রিয় একটি মাধ্যম। পঞ্চগড়ের নিকটবর্তী সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট, পঞ্চগড় জেলা শহর হতে সড়কপথে ৯০ কিমি দূরে অবস্থিত। সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট, প্রতিদিন প্রায় ৩০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে। ঢাকা থেকে আকাশপথে সৈয়দপুর যেতে সময় লাগে ৫০ থেকে ৫৫ মিনিট। ঢাকা থেকে আকাশপথে সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে নেমে সড়কপথে পঞ্চগড় পৌঁছতে সর্বমোট সময় লাগে মাত্র ৩ থেকে ৪ ঘন্টা। সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট, থেকে সড়কপথে পঞ্চগড় যাবার জন্য বিমান সংস্থাগুলোর নিজস্ব বা সম্মিলিত গাড়ির বাবস্থা রয়েছে, তাছাড়া সৈয়দপুর এয়ারপোর্টের সামনেই গাড়ি ভাড়া বা রেন্ট-এ-কার পাওয়া যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব বিমান সংস্থা ঢাকা সৈয়দপুর রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে তারা হলঃ
(১) বিমান বাংলাোদশ এয়ার লাইন্স
(২) ইউ এস বাংলা এয়ার লাইন্স
(৩) নভোএয়ার
(৪) বিজেন্ট এয়ারওয়েজ
এছাড়া রাজশাহীর হযরত শাহ্ মখদুম এয়ারপোর্ট -এ নেমেও সড়কপথে পঞ্চগড় যাওয়া যায়। আর যদি হেলিকপ্টারে যেতে চান তাহলে, ঢাকা ও পঞ্চগড়ের মধ্যে আকাশপথের দূরত্ব ১৮৬ নটিক্যাল মাইল। ঢাকা থেকে পঞ্চগড় আপনার ভ্রমণের দিকটি হবে উত্তর-পশ্চিম (উত্তর থেকে -৩২ ডিগ্রি)।
থাকার ব্যবস্থা
আবাসিক হোটেল ও গেস্ট হাউস
পঞ্চগড় শহরে:
সেন্ট্রাল গেস্ট হাউস: এটি পঞ্চগড় সদর বাজারের একটি পরিচিত হোটেল।
হোটেল মৌচাক: পঞ্চগড় বাজারের কাছাকাছি একটি থাকার জায়গা।
হোটেল রাজনগর: এটিও পঞ্চগড় বাজার এলাকায় অবস্থিত।
হিলটন বোর্ডিং: কদমতলা, পঞ্চগড় বাজারে অবস্থিত একটি আবাসিক বোর্ডিং।
সরকারি রেস্ট হাউস: জেলায় বিভিন্ন সরকারি থাকার ব্যবস্থা আছে।
তেঁতুলিয়ায়:
ডাহুক টি রিসোর্ট: তেঁতুলিয়ার প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার জন্য একটি ভালো জায়গা।
তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো : তেঁতুলিয়াতে থাকার একটি ভালো বিকল্প।
কীভাবে ব্যবস্থা করবেন
আপনি আপনার বাজেট অনুযায়ী সরকারি গেস্ট হাউস, প্রাইভেট বোর্ডিং বা হোটেল বেছে নিতে পারেন।
কিছু হোটেলের তথ্য পঞ্চগড় ভ্রমণ গাইড ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।
বিশেষ টিপস
তেঁতুলিয়া এবং পঞ্চগড় শহর – দুটি জায়গাতেই থাকার ব্যবস্থা পাওয়া যায়।
আপনার ভ্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী, পঞ্চগড় শহর বা তেঁতুলিয়া, যে কোনো একটি বেছে নিতে পারেন।
জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, শীতের এই সময় দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। সেই সঙ্গে পঞ্চগড়ের অনেক পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। পর্যটকরা যেন নির্বিঘ্নে তাঁদের ভ্রমণ উপভোগ করতে পারেন, আমরা সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ছাড়া পর্যটকদের থাকার জন্য তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতে পুরনো দুটি ভবনের পাশাপাশি বেরং কমপ্লেক্স নামে নতুন একটি বাংলো নির্মাণ করা হয়েছে। আশা করি পর্যটকরা পঞ্চগড়ে ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন।
কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া দেখতে সামর্থ্যবানরা ছোটেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলা শহরের টাইগার হিলে। টাইগার হিলই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখার সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। কেউ কেউ যান সান্দাকপু বা ফালুট। কেউবা নেপালে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিন্তু ঘরোয়া পরিবেশে নিজের মতো করে দেখার সুযোগ মেলে কেবল পঞ্চগড়ে।