আগুন নেভাতে জীবন বাজি: ১০বছরে ২৪ফায়ার ফাইটারের মৃত্যু

প্রশান্তি ডেক্স ॥ গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণ থেকে আগুন লাগে। ঘন ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাস আর লেলিহান শিখায় চারপাশ অন্ধকার। ঠিক তখনই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুনের ভেতরে যান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। মানুষ বাঁচাতে গিয়ে দগ্ধ হন চারজন ফায়ার ফাইটার। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের অভিজ্ঞ সদস্য শামীম আহমেদ (৪০)।

গত সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) আগুন নেভানোর সময় শতভাগ দগ্ধ হয়ে পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় এখনও দুইজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। সহকর্মীরা বলছেন, শামীম ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও অভিজ্ঞ ফায়ার ফাইটার। তার মৃত্যু শুধু বাহিনীতে নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও শোকের সৃষ্টি হয়েছে।

গত মঙ্গলবার রাতে ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন ও সহকর্মীরা।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিহতের ঘটনায় শুধু শামীম নন, গত বছরের (২০২৪) ২৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড নেভানোর সময় মারা যান ফায়ার ফাইটার মো. সোহানুর জামান নয়ন। গভীর রাতে পানির পাইপ কাঁধে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় দ্রুতগামী ট্রাকের ধাক্কায় তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। বাহিনীর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডে। সেখানে একসঙ্গে ১৩ ফায়ার সার্ভিসকর্মী প্রাণ হারান। এছাড়া ২০০৮ সালে চারজন এবং ২০০০ সালে তিনজন ফায়ার ফাইটার অপারেশনাল কাজে গিয়ে প্রাণ হারান।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপারেশনাল কাজে নিহত ফায়ার সার্ভিসকর্মীর সংখ্যা ছিল ২৩ জন। শামীম আহমেদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ  সংখ্যাটি দাঁড়ালো ২৪ জনে। এ সময়ে আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে (১৯৮১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত) দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন মোট ৪৬ জন ফায়ার সার্ভিসকর্মী। এছাড়া ১৯৬৬, ১৯৭১ ও ১৯৭৩ সালে আরও তিনজন প্রাণ হারান।

নিহত এই ৪৯ জনের মধ্যে ফায়ার ফাইটার রয়েছেন ৩৫ জন, গ্রুপ লিডার সাতজন এবং ড্রাইভার তিনজন। একজন করে রয়েছেন সিনিয়র স্টেশন অফিসার, স্টেশন অফিসার, ডুবুরি ও নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘আমরা যখন আগুনের ভেতরে ঢুকি, তখন নিজের কথা মাথায় থাকে না। মানুষের জীবন বাঁচানোই আমাদের মূল চিন্তা। কিন্তু সেই ঝুঁকি আমাদের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

প্রতিটি ঘটনার পর ফায়ার ফাইটারদের পরিবারে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। শামীম আহমেদের পরিবারে রয়েছেন স্ত্রী ও দুই সন্তান। সহকর্মীরা জানান, তাদের প্রতিদিনের কাজের ভেতর থাকে ভীতি, ফিরে আসা হবে নাকি আর ফিরবেন না।

ঝুঁকি কমাতে বাড়তি সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দরকার : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসায়নিক গুদাম বা শিল্প এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়। উন্নত প্রটেক্টিভ গিয়ার, শ্বাসনালী সুরক্ষা, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে প্রাণহানি কমানো সম্ভব। সংস্থাটির সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইঞ্জিনিয়ার আলী আহম্মেদ খান বলেন, “রাসায়নিক অগ্নিকাণ্ডে কাজ করার জন্য আমাদের আরও উন্নতমানের সরঞ্জাম দরকার। অনেক সময় পোশাক ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের মান যথেষ্ট না হওয়ায় দগ্ধ বা বিষক্রিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।”

পরিবারের জীবনে অসহায়তা প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে থেকে যায় একটি পরিবার, যারা হঠাৎ করেই জীবিকা ও নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। সামাজিক নিরাপত্তা ও বিমা কাঠামো শক্তিশালী করা গেলে এ ধরনের বীরদের পরিবার কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে মনে করছেন ফায়ার ফাইটাররা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.