প্রশান্তি ডেক্স ॥ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে এমন কিছু আইনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯’ অন্যতম। ‘সন্ত্রাসবাদী কাজ’ এর বিস্তৃত সংজ্ঞা, অস্পষ্ট পরিভাষা এবং নির্বিচারে প্রয়োগের শঙ্কার কারণে ২০০৯ সালে এই আইন সমালোচনার মুখে পড়ে। বর্তমানে আবারও কালো আইন খ্যাত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এই আইনটি সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তা আবারও ব্যবহার করা হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, আইনটির সংশোধনীগুলো সুশীল সমাজের সঙ্গে এবং সংসদে বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই পাস করা হয়েছে, যার ফলে এগুলোর অপব্যবহারের শঙ্কা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানীর ভাটারা থানার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গোপন বৈঠকের ঘটনায় মেজর সাদেকুলের স্ত্রী সুমাইয়া তাহমিদ যাফরিনকে গ্রেফতার, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের মিছিল করার অভিযোগে সাবেক যুগ্ম সচিব মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলামকে গ্রেফতারসহ নিষিদ্ধ সংগঠনের ঝটিকা মিছিলের অভিযোগে অনেককে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি ডিআরইউতে একাত্তর মঞ্চের অনুষ্ঠানের অভিযোগে আবু আলম শহীদ খানসহ আরও অনেককে এই আইনেই কারাগারে পাঠানো হয়।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও সমালোচনা
২০০৪ সাল থেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন করার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইন গৃহীত হয়। এই আইন প্রণয়নের আগেই ২০০৮ সালের জুন মাসে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশটি ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বিল আকারে উত্থাপন এবং সেটি আইন হিসেবে পাস করা হয়। সে সময় মনবাধিকার সংস্থাগুলো সমালোচনা করে বলেছিল এই আইনটিতে অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট নয়, আইনের অপব্যবহারের শঙ্কা আছে। পরে এই আইনটি ২০১২ এবং ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। সংশোধনীর পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা ওয়াকআউট করে দাবি করেন, এই্ আইনের ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।
নতুন সংশোধনী ২০২৫
চলতি বছরের মে মাসে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তি বা সত্তা এবং তাদের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করে ‘সন্ত্রাসবিরোধী সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫’ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। বৈঠকের সারসংক্ষেপে বলা হয়, ‘‘কতিপয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধে কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়। সে আইনে কোনও সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কোনও বিধান ছিল না। তাই ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’-কে সময়োপযোগী করে উক্ত আইনের অধিকতর সংশোধন সমীচীনও প্রয়োজন।’’ এরপর সন্ত্রাসবিরোধী অধ্যাদেশে যুক্ত নতুন ধারা সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে শঙ্কা সৃষ্টি করবে বলে এর নতুন ধারাটি স্থগিত এবং পুনর্বিবেচনার দাবি করে সম্পাদক পরিষদ।
‘মতবিরোধ ও স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে’
এই আইনের প্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ‘‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে জীবন ও জীবিকার অধিকার দমন করতে পারে এবং ভিন্নমত ও বিরোধীদের দমনে এই আইন ব্যবহার হতে পারে। বর্ধিত জরিমানা এবং পরবর্তী সময়ে সংশোধনী সম্পর্কেও উদ্বেগ রয়েছে বলে পর্যালোচকরা যুক্তি দেন যে, এতে ন্যায়বিচারের ‘গর্ভপাত’ হতে পারে।’’
তিনি বলেন, ‘‘সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ‘সন্ত্রাসবাদী কাজ’-এর সংজ্ঞাকে অত্যধিক বিস্তৃত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ চাইলে এর অপব্যবহার করতে পারে। বিশেষত, ২০১৩ সালের সংশোধনীর পরে, বিবৃতি প্রকাশ বা সরকারবিরোধী সংস্থাগুলোর জন্য সমাবেশের মতো কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ করার জন্য আইনটি সমাালোচিত। এ পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রাথমিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্বারা রাজনৈতিক কার্যকলাপ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগীদের লক্ষ্যবস্তুুতে নিষিদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসে গৃহীত এই সংশোধনীটি ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের পরিধি প্রসারিত করে যেকোনও সত্তার কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করার অন্তর্ভুক্ত করে, কেবল সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘একটি বড় রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে এবং জনসমাগম দমন করতে এই আইনের ব্যবহার তীব্র নিন্দনীয়। ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করতে এই আইনকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই উন্নয়নের মধ্যে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট (এটিইউ) সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আমি মনে করি, বৃহত্তর আইনের বিধানগুলো, বিশেষত সত্তাকে নিষিদ্ধ করা এবং অভিব্যক্তি দমন সম্পর্কিত, মতবিরোধ ও স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপণ্ন করার ঝুঁকি নিয়েছে।’’
সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের কালো আইন অহরহ ব্যবহার দেখা যাচ্ছে যা দুর্ভাগ্যজনক উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘‘আমরা যেসব আইন কালো আইন বলে থাকি, মানবাধিকার কর্মীরা এই ধরনের আইন অপব্যবহারের বিষয়ে সবসময় কথা বলেন। সম্প্রতি ‘মঞ্চ ৭১’ নামে একটি সংগঠনের অনুষ্ঠান থেকে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের আইনের ব্যবহারে মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হয়।’’ তিনি বলেন, ‘‘শুধু এই আইনের অপব্যবহার নয়, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে হত্যা মামলা ও ঢালাওভাবে মামলা দিয়ে আটকানো হচ্ছে। যেখানে সাধারণ মানুষও ভুক্তভোগী হচ্ছে। একদিকে পুরোনো আমলের মতো যার-তার বিরুদ্ধে যেকোনও মামলা দেওয়া, আরেকদিকে কালো আইনের যে প্রয়োগ সাম্প্রতিককালে দেখছি, সেখান থেকে বেরিয়ে না এলে গণতন্ত্রের স্মোগান দিয়ে লাভ হবে না। ঠিক যেমন পুরোনো সময়ে স্বাধীনতার কথা বলে স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান নিয়ে লাভ হয়নি।’’
মানবাধিকার সংগঠন ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. হুমায়ন কবির পল্লব বলেন, ‘কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ ব্যতীত কারও বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের দায় চাপিয়ে দিয়ে হেনস্থা করা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের চরম অপব্যবহারের শামিল। প্রত্যেক সরকার এই আইনটিকে দমন- পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমান সময়ে আইনটির অপব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অনেক গুণীজনকেও সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে এই আইনে হেনস্তা করা হচ্ছে। এই অপব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।’