টিআইএন॥ আজোও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে ড: কামাল সাহেব কোথায়? তিনিতো জাতির ক্রান্তিকালে কোনসময়ই পাশে থাকেননি। বিশেষ করে যখন উনার প্রয়োজন তখনই তিনি দেশের বাইরে। এখনওকি তাই। হয়তবা… সেই ৭১ থেকে ৭৫ এবং সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি সকল দুর্যোগ থেকে দুরে থেকে জাতিকে শুধু হতাশই করেননি বরং জাতির মনে নানাহ সন্দেহের বীজ বপন এবং তা এখন ডাল-পালা মেলে বাতাসে দোল খাচ্ছে। উনাকে দায় দিয়ে এবং হোতা উপাধি দিয়ে কিছু উপস্থাপনা করা য়ায় নি¤œরূপ।
শাহবাগে শেরাটন হোটেলে ঢুকতেই হাতের বামে কফিশপ। ৮০র দশকে এই কফিশপের নিয়মিত অতিথি ছিলেন সিরাজুল আলম খান। রাজনীতির রহস্য পুরুষ। যাঁকে তুলনা করা হয়, হ্যামিলনের বংশীবাদকের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পর ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নামের একটি দর্শন নিয়ে তিনি তরুণদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন। জাসদের তাত্ত্বিক গুরু। মেধাবী তরুণদের বিপথগামী করার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। তারপর কিছু তারুণ্য পেরোনো মানুষের কাছে তিনি দাদা। শেরাটন কফিশপের আড্ডায় দাদার মন্ত্রমুগ্ধ অনুসারীরা বসে থাকতো। ততোদিনে জাসদের বিপ্লব স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে। বিভ্রান্ত তরুণদের অনেকে দেশান্তরী। কেউ জেলে, আর একটু বুদ্ধিমানরা ব্যবসা, চাকরিতে ঢুকে পড়েছেন। কাজের ফাঁকে এরাই দাদার সঙ্গী। এই আড্ডায় রাজা-উজির থেকে শুরু করে বিশ্ব পরিস্থিতি সবই আসতো। সিরাজুল আলম খান তাঁর মতো যেকোনো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতেন। এরকম এক আড্ডায় বাংলাদেশে ভবিষ্যত, এরশাদের সামরিক শাসন নিয়ে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ সিরাজুল আলম খান জানতে চাইলেন ‘ড. কামাল হোসেন কোথায়? দেশে না বিদেশে?’ আড্ডায় উপস্থিত একজন জানালেন, ড. কামাল দেশেই। সিরাজুল আলম খান বললেন, তাহলে এবার কিছু হচ্ছে না। খেয়াল রাখবা, ড. কামাল হলো পিঁপড়ার মতো, আগাম খবর পায়। ড. কামাল যদি বিদেশে থাকে, তাহলে বুঝবা কিছু একটা হইবো।’ সত্যি তো? বাংলাদেশে প্রতিটি পট পরিবর্তনে ড. কামাল উড়ে যান, তাঁকে পাওয়া যায় না কোনো সংকটে।
ধরা যাক, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা। ড. কামাল কোথায় ছিলেন? বলা হয়, ড. কামালকেও পাকিস্তান জান্তা সরকার গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কোনো গবেষকই এমন কোনো প্রমাণ পাননি যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বরং, দু একজন গবেষক দেখছেন, পাকিস্তান অক্ষুন্ন রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণান্ত কূটনৈতিক তৎপরতায় ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা ছিল। তিনিই পাকিস্থানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আলাপ আলোচনা চালিয়ে নিয়েছিলেন।
৭৫ এর ১৫ আগস্টের আগেই ড. কামাল হোসেন বিদেশ চলে যান। জাতির পিতার হত্যাকন্ডের পর ড. কামাল জার্মানিতে জাতির পিতার দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনার সাথে সাক্ষাতও করেন। এসময় শেখ রেহেনা তাঁকে অনুনয় করেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ড. কামাল যেন বিশ্ব জনমত গড়ে তোলেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ড. কামাল হোসেন কিছুই করেন নি।
৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে সেনা বিদ্রোহে মারা যান। এর চারদিন আগে ২৬ মে ড. কামাল ওপেকের আইনজীবী প্যানেলে যোগ দিতে আবুধাবি যান। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ড. কামালকে প্রথমদিকে খুবই তৎপর দেখা যায়। ১৯৮৫ সালে এরশাদ সরকার হরিপুর গ্যাসক্ষেত্র অক্সিডেন্টাল নামের এক বহুজাতিক কোম্পানিকে লিজ দেওয়ার আয়োজন করলে, সারাদেশ ফুঁসে উঠে। হরিপুর গ্যাসক্ষেত্র ইজারা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এসময় এরশাদ সরকারের জ্বালানি মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এক সংবাদ সম্মেলনে বোমা ফাঁটানোর মতো তথ্য হাজির করেন। তিনি দেখান, সরকার ও অক্সিডেন্টাল চুক্তির আইনগত পরিদর্শক ড. কামাল হোসেন। তিনিই এই চুক্তির প্রতিটি ধারা দেখে দিয়েছেন এবং এজন্য পারিশ্রমিক নিয়েছেন। একদিকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন অন্যদিকে এরশাদ সরকারের চুক্তির আইন বিশেষজ্ঞ। জাতি হতবাক হয়ে যায়।
৯০ এ এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ২৭ নভেম্বর ড. কামাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারি দেন। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর হাতে নিহত হন ডা. শামসুল আলম মিলন। আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানান। ৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরেন ড. কামাল হোসেন।
৯১ এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ড. কামাল হোসেন গণফোরাম গঠন করেন। দল বদল করলেও সংকটে তাঁর বিদেশ যাত্রা বন্ধ হয় নি। ২০০৭ সালের প্রথম দিন ড. কামাল লন্ডনে পাড়ি দেন। ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ জানুয়ারি ড. কামাল দেশে ফেরেন। পরদিনই তিনি সাংবাদিকদের বলেন ‘এই সরকার যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারে, নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এই সরকারের দায়িত্ব পালনে কোনো সাংবিধানিক বাধা নেই।’ ড. কামালের মতো সংবিধান বিশেষজ্ঞের এহেন মন্তব্যে জাতি বিস্মিত হয়ে যায়।
বিভিন্ন সংকটে ড. কামাল হোসেনের দেশ ত্যাগ কি কেবলই কাকতলীয়? নাকি সিরাজুল আলম খানের রহস্যময় হাসি ভরা প্রশ্নের মতোই এক রহস্য। এইতো ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ দাতা এবং পট পরিবর্তনের অনুঘটকদের একজন কামাল কি করেন? আপনারা সজাগ থাকুন এবং কামালকে গোয়েন্দা নজরদারীতে রাখুন। সময় ও সুযোগ হলে তালে রিমান্ডে নিলে সকল রহস্য যা এতদিন লুকিয়ে রেখেছেন তা বের হয়ে আসবে। চলমান…।