রা ইসলাম॥ ২৮ অক্টোবর, ২০১২। সাতদিনের সফরে ভারতে এলেন বাংলাদেশের বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ২০০১-০৬ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ভারতের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করাই এই সফরের প্রধান লক্ষ্য ছিল। ভারত সরকারও বাংলাদেশে সব দলের সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতিতে বেগম জিয়াকে আমন্ত্রণ জানায়। বেগম জিয়াও সফরের আগে এক নিবন্ধে দুই দেশের অটুট বন্ধুত্বকে এগিয়ে নেওয়ার আশাবাদ জানান।
বেগম জিয়ার বৈঠক শুরু হয় তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকের মধ্যে দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী, সোনিয়া গান্ধী সহ অনেকের সঙ্গেই বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তবে এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ছিল জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেননের সঙ্গে সাক্ষাৎ। এই বৈঠক ছিল বিএনপির জন্য সবথেকে চ্যালেঞ্জিং। ২০০৪ সালে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জে এন দীক্ষিত আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ আনেন। ডিসেম্বরের দীক্ষিত কমিশন, ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনায় সরাসরি তারেক রহমানকে অভিযুক্ত করে। কমিশনের ওই রিপোর্টে তারেককে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবেদনে তারেক জিয়াকে ‘বিশ্বাসঘাতক, লোভী এবং মিথ্যাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কারণ, ২০০০ সালে তারেক জিয়া ভারত সফর করেন। ওই সময় ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছিল। যাতে তারেক ভারতে গ্যাস রপ্তানি, ট্রানজিট সুবিধা প্রদান এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর একটি প্রতিশ্রুতিও পূরণ করেননি। উল্টো, বাংলাদেশকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেয়। তারেক জিয়া ওই সময়ে নিয়মিত পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সঙ্গে বৈঠক করতো বলেও ভারতের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে।
বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের শুরুতেই শিবশংকর মেনন একান্তে বেগম জিয়ার সঙ্গে কিছু কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করেন। আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তাঁরা স্পষ্ট বলেন, ‘বিএনপিকে ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশকে বিচ্ছিনতাবাদীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবেন না।‘ মেনন সবই শোনেন। এরপর একান্ত বৈঠকে মেনন জানতে চান ‘হোয়াটস অ্যাবাউট তারেক রহমান, ইওর সান।‘ বেগম জিয়া প্রথমে বুঝতে পারেন নি। তিনি ধারনা করেছিলেন, তারেক জিয়ার স্বাস্থ্যগত খবর জানতেই বোধহয় মেনন এ প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু আস্তে আস্তে তাঁর কাছে পরিস্কার হয়, তারেকের খবর নয়, বিএনপিতে তাঁর প্রভাব ও ক্ষমতাবলয় সম্পর্কেই আগ্রহী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। আলোচনা বেশ খানিকটা গড়ায়। ভারত চায়, তারেক বিযুক্ত বিএনপি। বিএনপি থেকে তারেককে আলাদা করতে। কিন্তু বেগম জিয়া কিছুতেই তাতে রাজি নন। আলোচনা শেষ হয়। পরে শিবশংকর মেননের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শমসের মুবিন চৌধুরী। শমসের মুবিনের সঙ্গে শিবশংকর মেননের পূর্ব বন্ধুত্ব। অনানুষ্ঠানিকভাবে মেনন জানান, তাঁরা তারেক জিয়াকে বিশ্বাস করেন না। এই বার্তাটি যেন বেগম জিয়াকে জানিয়ে দেওয়া হয়। শমসের মুবিন বার্তাটি গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু ২০১৫ তে বিএনপির লাগাতার আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার পর অক্টোবরে তিনি বেগম জিয়াকে তারেকের ব্যাপারে ভারতের অবস্থান জানান । বেগম জিয়া এই বক্তব্যে সাবেক এই কূটনীতিকের উপর বেজায় ক্ষেপে যান। ওই মাসেই ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন শমসের মুবিন চৌধুরী। বিএনপিও হয়ে যায় ভারত বিরোধী। আজও তাদের সেই বিরোধী অবস্থান অব্যাহত। কিন্তু কতক্ষণ থাকবে তা বলা মুশকিল এবং ক্ষমতার মোহে আবা কি না করে বসে তাই এখন দেখার বিষয়।