বা আ ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের বন্যা দুর্গতদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, তারা নতুন ফসল ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত আগামী তিন মাস ত্রাণ সমগ্রী পাবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বন্যা দুর্গতদের নতুন ফসল ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত আগামী তিন মাস এই খাদ্য সাহায্য অব্যাহত থাকবে।’
১০ টাকা কেজি দরে ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে চাল বিতরণের প্রসংগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবার কাছেই ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছবে। আপনাদের একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে এবং আমাদের ওপর আস্থা রাখতে হবে।
বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শনের জন্য বিমানবাহিনীর একটি হেলিকাপ্টারে প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে এখানে পৌঁছেন।
প্রধানমন্ত্রী পরে দিনাজপুর জেলা সদরের দিনাজপুর জেলা স্কুল এবং বিরল উপজেলার তেঘাড়া হাই স্কুল ত্রাণ শিবিরে স্থানীয়দের মাছে ত্রাণ সমাগ্রী বিতরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদিও দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে তথাপি বন্যায় ফসলের ক্ষতি হওয়ায় সতর্কতার অংশ হিসেবে সরকার বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অন্যান্যের মধ্যে অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান, দলের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ ইকবালুর রহিম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি বক্তৃতা করেন।
এছাড়া, পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যরিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জ্বল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বন্যার পানি নামার সাথে সাথে নানারকম রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে এই বিষয়টি খেয়াল রাখার নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, এখনও বহু ক্ষেতে পানি জমে আছে, ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি এই সমস্ত ক্ষেতের আইল কেটে দিয়ে বা যে কোন পন্থায় পানিটা বের করে দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রাস্তা-ঘাট নষ্ট হয়েছে। রেল লাইনে পানি ঢুকে গিয়েছে, আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যেমন সড়ক এবং সেতু মন্ত্রণালয় এবং আমাদের এলজিইডি, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় আগে থেকেই তৈরী হয়ে আছে। বন্যার পানি নেমে গেলেই রাস্তা মেরামতের কাজ ইনশাল্লাহ আমরা শুরু করে দেব এবং নিজেরা যাতে নিজেরদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে পারেন সেই সুযোগ আমরা করে দেব।
ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ সংস্কারে সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী, অনসার-ভিডিপির সদসদের নিয়োজিত করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এছাড়াও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরী করে সেখানে পাঠানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমরা চাই প্রত্যেকটা মানুষ ভালো থাকুক। আজকে যখন বন্যার খবর পেয়েছি সাথে সাথে আপনাদের ভোটে যারা নির্বাচিত সেসব সংসদ সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ছুটে এসেছি।
তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত জীবনে চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমি চাই বাংলার মানুষ যেন ভালো থাকে। আপনাদের জীবন যাতে উন্নত হয়। আপনাদের ছেলে-মেয়েরা যেন লেখাপড়া শিখতে পারে, আপনারা যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারেন এবং যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা আপনাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি- সেটাই আমাদের দায়িত্ব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এখানে পর্যাপ্ত পরিমান রিলিফের ব্যবস্থা করেছি। প্রত্যেকেই যেন রিলিফ পান তার ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি গৃহহীনদের পুণর্বাসনে ঘর নির্মাণ করে দেয়ার এবং তাদের মাঝে খাস জমি বিতরণ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘খাসজমি দেব ভূমিহীনদের এবং যাদের ঘর নাই আমরা ঘর করে তৈরি করে দেব।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কৃষক ভাইদের যাদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে-তারা যেন পুনরায় কৃষিঋণ পেতে পারেন এবং বীজ ও বীজতলার ব্যবস্থাও করা হবে।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন-প্রায় ২ কোটি কৃষক কৃষি উপকরণ কার্ড পেয়ে থাকেন। ১ কোটির মত কৃষক ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন এবং ভর্তুকির টাকা সরাসরি তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। কাজেই এই ক্ষেত্রে যা যা করণীয় আমরা তা করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীনতাই এনে দেন নাই, বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেও কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় মানুষ অন্তত, দু’বেলা খাবার পেত এবং মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। মানুষের ভেতরে একটা স্বস্তি এসেছিল। ঠিক সেই সময় ’৭৫এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর ৬ বছর তিনি দেশে ফিরতে পারেননি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারি জেনারেল জিয়া আমাদের দেশে আসতে দেয় নাই। আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি নির্বাচন করার পর আমি দেশে ফিরেছি এবং দেশে ফেরার পর থেকেই বাংলার মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রধান বলেন, উত্তরবঙ্গে একসময় মঙ্গা লেগেই থাকতো। আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসার পর আমরা সেই মঙ্গা দূর করেছিলাম।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসেরও চৌধুরী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বিকেলে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী হেলিকপ্টার ছিনাই ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন খেলার মাঠে অবতরণ করে। তিনি ঢাকা ফেরার আগে পাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন।
এবারের বন্যায় ২৭ জেলার ১৫৪ উপজেলার ১০৩৮টি ইউনিয়নের প্রায় ১৩ লাখ ২২ হাজার পরিবারের ৫৭ লাখ ১৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও গৃহহারা হয়েছে।
২ লাখ ৯৭ হাজার মানুষ ৯৪১টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
সরকার বন্যার্তদের মাঝে ২০ হাজার ৪৭০ টন জিআর চাল, ৩৭ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ৬ কোটি ৫৬ লাখ নগদ টাকা বিতরণ করেছে।
বন্যায় ৪০ হাজার ১৬৭টি বাড়ী সম্পূর্ণ এবং ৪ লাখ ৯১ হাজার বাড়ী আংশিক এবং ৪ লাখ ৬৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া প্রায় ২ হাজার ৫৫৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যায় প্রায় ১শ’ জনের প্রাণহানি ঘটনা ঘটছে এতে ৩১ কিলোমিটার সড়ক সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৭৮৯ কিলোমিটার সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২৭ জেলায় জরুরি চিকিৎসা সেবার জন্য ১ হাজার ৬২৭টি মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে।
বন্যা পরিস্থিতি ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মনিটর করতে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট জেলা উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।