আমাদের সমাজে এখনও অনেক ভাল দিক রয়েছে যেগুলোকে অগ্রাধীকার দিয়ে চর্চা করলে হয়ত আগামীর প্রত্যাশা পুরণে সহায়ক হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দৃষ্টিভঙ্গি। আমি বা আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে মূল্যায়ন করছি। এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করেই সমাজ, দেশ এমনকি সর্বোপরি আমাদের রাষ্ট্র অগ্রসর হয় নব্য বা নতুন কোন স্বপ্রতিভ উদীয়মান দিগন্তের দিকে। আমরা সমাজে বিভিন্ন বৈচিত্র লক্ষ করি। কারন কিছু এলাকা বা অঞ্চল ভিত্তিক আবার কিছু নিজেদের অর্জিত সংযোজন; কখনো কখনো বাইরের কোন সংস্কৃতির অবিকল নকল বা দেখতে দেখতে শিখা বিষয়গুলোর দিকে। তবে এর প্রত্যেকেটিই আমাদের সমাজকে বা সমাজবদ্ধ জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। এই সহায়তা কোন কোন সময় মঙ্গলের পক্ষে আবার কোন কোন সময় অমঙ্গলের পক্ষে। এই মঙ্গল এবং অমঙ্গল উভয়ই আমাদের সমাজ তথা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গে উৎপ্রোতভাবে জড়িত। এই দুই উপাখ্যান বা অধ্যায়কে আমরা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা এর চর্চা হিসেবে দেখতে ও ভাবতে পারি। আমাদের ভাবনার জগতের বিশালতার ব্যাপ্তি বৃদ্ধিতে উভয়েরই দরকার রয়েছে, তবে চর্চার ক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন ইতিবাচক মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গির। আর যদি তাই করতে পারি তাহলেই কিন্তু আমরা সফল।
কিভাবে নেতিবাচক ভাবধারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রমানিত হওয়া সত্ত্বেও আমরা ইতিবাচক ভাবধারার চর্চায় মনোনিবেশ করব বা করতে পারি। এই বিষয়ে বা ব্যাপারে সৃষ্টিকর্তাই আমাদেরকে সহায়তা করতে পারেন। কারণ তিনি সকল নেতিবাচকতাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে সকলকে পরিচালনা দান করে যাচ্ছেন এবং সকলের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর মনোভাব প্রকাশ করে যাচ্ছেন। তারপরেও আমাদের এই দেশের জন্মদাতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙ্গালী বহু উপাধিতে সমাধৃত মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বাধীনতা পরিবর্তী উপলব্দি এবং অভিজ্ঞতার অর্জন থেকে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া শিক্ষাটুকুই যথেষ্ট হতে পারে আগামীর ইতিবাচক মনোভাবের বহিপ্রকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে। যদিও আমাদের চর্চার ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে তারপরও বলব এই ভিন্নতা নির্ভর চর্চাটুকু চালিয়ে যেতে হবে।
আসা যাক মূল শিক্ষায়: বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসা ছিল সকল মানুষের। আর এই ভালবাসা থেকেই একদিন এক কৃষক তার ফসলী জমির প্রথম সবজিগুলো নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসে ৩২নম্বরের বাড়িতে হাজির হলো। তার আবদার প্রীয় নেতা এবং ভালবাসার ধন বঙ্গবন্ধু এই সবজি খাবে; তখন দারোয়ান সবজি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলে একভক্ত গ্রাম থেকে কষ্ট করে সবজি নিয়ে এসেছে আপনার জন্য। তখন বঙ্গবন্ধু ঐ সবজি গ্রহণ করে তাঁর ভালবাসা প্রকাশ করনার্থে ২০টি টাকা দিয়ে দারোয়ানকে বলে তুমি ঐ সম্মানীত মানুষটিকে এই টাকাটা দিয়ো আর আমার ভালবাসা দিয়ো। সে অনেক কষ্ট করেছে এবং কষ্ট করেই আমার কাছে নিয়ে এসেছে যার মুল্য কখনোই আমার দ্বারা পরিশোধ করা সম্ভব না। তাই শুধু আমার ভালবাসাই রইলো তার জন্য। তখন দারোয়ান ঐ ঘর থেকে বের হয়ে ভাবলো ২০ টাকা কেন দেবো, না এত বেশী দেবো না; ১০ টাকা দিলেই হবে। এই ১০ টাকাই অনেক বেশী। তখন দারোয়ান ঐ কৃষকের কাছে গিয়ে বলল বঙ্গবন্ধুর ভালবাসার কথা এবং ১০টাকা দিয়ে বলল এটা রাখ। তখন কৃষক বলল আমি টাকা নেব না। আর আমিতো সবজি বিক্রি করতে এখানে আসি নাই। যদি বিক্রি করতে আসতাম তাহলেতো বাজারে যেতাম। এখানে এসেছি আমার ভালবাসা এবং মহান নেতাকে সম্মান করতে। টাকা নেবো না। তখন দারোয়ান টাকাটা দিয়ে চলে গেল। তখন ঐ কৃষক চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বলল আমিতো টাকা নিতে আসিনাই। আর আমার টাকা লাগবে না। নেন আপনার টাকা। তখন বঙ্গবন্ধু ঐ কৃষকের ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে তার ভালবাসা গ্রহণ করলেন। কৃষক টাকাটা ফেরত দিলো যা দেখে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলো ১০ টাকা কেন, আমিতো তোকে ২০টাকা দিয়েছিলাম। তখন কৃষকের সাদাসিদে উত্তর ১০ আর ২০ আমি বুঝিনা আমি বুঝি টাকা ফেরত দিতে হবে। ভালবাসা কখনো বিক্রি হয় না বা টাকা দিয়ে মূল্যায়ন হয়না। … তখন বঙ্গবন্ধু একটু দম নিয়ে চিন্তা করলেন; এই হলো আমাদের অবস্থা দোতলা থেকে বাসার গেইটে যাইতেই যদি অনুদান বা ভালবাসার উপহার অর্ধেকে পরিণত হয় তাহলে দেশের শেষ প্রান্তে পৌঁছতে কি হবে ? এই ভাবতে ভাবতেই তিনি পায়চারী করছিলেন।
আরেকটি শিক্ষা হলো সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল তিনি এনেছিলেন; কিন্তু সেই সাড়ে সাত কোটির মধ্যে তিনিও ছিলেন। বন্টনের পর না পাওয়ার হা হা কার শুরু হলে তিনি বলেছিলেন… আমার ভাগের কম্বলটি কোথায়? কি চমৎকারই না এই দৃষ্টান্তগুলো। তখন তাঁর মুখে একটি বানী উচ্চারিত হলো “দেশ স্বাধীন করে মানুষ পায় স্বর্ণ, তেল ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসের খণি আর আমি পেলাম চোরের খণি”
উল্লেখিত শিক্ষা এবং দৃষ্টান্তের পরও কিন্তু বঙ্গবন্ধু সবাইকে ক্ষমা করে ভালবেসে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে দেশ উন্নয়ন ও পূর্ণগঠনে নিয়োজিত হয়েছিলেন। কোন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বা চর্চা করেননি। বরং ইতিবাচক চর্চার দ্বার উন্মুক্ত রেখে সবাইকে নিয়ে ঐকবদ্য কাজ করেছেন। সবাইকে সমানভাবেই বিশ্বাস করেছেন। আমরা জানি আমাদের দেশের অবস্থা এবং এই দেশে বসবাসকারী মানুষের মনের অবস্থা কি, তাই প্রত্যেকেই যদি সন্দেহের উদ্ধে উঠে সকল নেতিবাচক মনোভাব প্রত্যাহার করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা করি তাহলেই চলমান অবক্ষয়ের ধারা রোধ হবে। বঙ্গবন্ধুর শেখানো ও দেখানো দৃষ্টান্তমুলক শিক্ষা কাজে পরিণত করলে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জয়জয়াকার রব উঠবে বিশ্ব দরবারে।
সামাজিক অবক্ষয় নামক ব্যধিতে নিমজ্জিত তরুন সমাজকে উদ্ধারকল্পে এগিয়ে আসতে হবে সকলকেই। পুনরুদ্ধার করতে হবে সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধকে। কোমায় থাকা বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। এর কুফলগুলি যা বর্তমানে দৃশ্যমান তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। জঙ্গি, সন্ত্রাস, চাদাবাজি, দুর্নীতি, অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকা, অন্যের বউ নিয়ে উধাও হওয়া, স্কুল, কলেজ পড়–য়া ছেলে-মেয়েদের বেপরোয়া জীবন যাপন এমনকি সত্য, সুন্দর, উপযুক্ত, সৎ, খাঁটি, সম্মান পাবার যোগ্য, যা ভাল ও প্রশংসার যোগ্য; এই সবের সম্পূর্ণ উল্টো পথের যাত্রা আজ সর্বত্র। এর সবই বন্ধকরা সম্ভব। আর এই নেতিবাচকতাকে সম্ভবে এবং কার্য্যে পরিণত করতে হলে প্রয়োজন আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার।
সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে আর সেই দায়িত্বটুকু পালনই যেন হতে পারে নেতিবাচক নোংরামী ও পাপ পঙ্কিলতাবিহীন জীবনের ইতিবাচক হাতিয়ার স্বরুপ। টাকার পেছনে না ছুটে সন্তান ও সময়ের পিছনে মূল্যবোধ নিয়ে ছুটেন। সন্তানকে সময় দিন এবং সন্তানের কি প্রয়োজন আর কি প্রয়োজন নেই তা মুল্যবোধের এমনকি ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে শিক্ষাদিন। সন্তানের খোজ রাখেন এমনকি জবাবদিহীতায় গড়ে তুলুন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মুল্যবোধের চর্চা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। পরিবারের বাইরের আচরণ যা নেতিবাচক তা ইতিবাচকে পরিণত করার প্রয়োজনে সামাজিক শিক্ষা এবং সামাজিক দায়িত্বের অর্ন্তভূক্ত হয়ে চর্চায় পরিণত হলে সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের ইতিবাচক এবং মুল্যবোধসমৃদ্ধ সুখী ও সমৃদ্ধশালী মঙ্গলকামী ব্যবস্থার দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। শৈশবে শিখেছি, মা-বাবা, চাচা, চাচি, মুরুব্বি শ্রেণীর লোকদের কাছে, মক্তব, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, স্কুল ও প্রতিবেশীর নিকট থেকে। চর্চার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা দিলেই শাসন পেয়েছি সমাজের মুরুব্বী শ্রেণেীর কাছ থেকে, শিক্ষকের কাছ থেকে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে, পরিবারের কাছ থেকে। যার জন্য পরিবর্তন হয়েছে নেতিবাচকতার এবং ফিরে এসেছে সুস্থধারার ইতিবাচক সমাজ ব্যবস্থার। জবাবদিহীতা ও দায়বদ্ধতা দুটোই একসঙ্গে কাজ করেছে আমাদের জীবনে তাই নিজে অন্তত ইতিবাচক চর্চার একজন আশাবদি মানুষ হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারি।
আজ যখন দেখি সমাজের খারাপ কাজগুলি অহরহ ঘটছে এবং কিছু মানুষ এর পেছনে ইন্দন দিয়ে যাচ্ছে আবার কিছু মানুষ এর বিরোধীতাও করছে তখন ভাবতে এবং অতীতে ফিরে গিয়ে গভীর ধ্যানমগ্নের মাধ্যমে একটি বিষয় চোখের সামনে ভেসে উঠে… যা আমাদের শৈশবে ছিল আর এখন এই সমাজে নেই বা অনুপস্থিত। আসুণ না আমরা ফিরে আসি সেই সুদুর অতীতের শান্তিময় শিক্ষায় যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণকারী ছিল সমাজের, পরিবারের, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, আত্মীয়স্বজনের এবং পরিবেশের ও প্রকৃতির সর্বোপরি সকলের। যদি আমরা সেই ভাবÑধারায় আবার ফিরে যেতে পারি তাহলে হয়ত সমাজের এই অবক্ষয় আর দেখা ও শুনা যাবে না। তবে মূল্যবোধবিহীন জীবন যাপনের ফলই হলো আমাদের আজকের এই হা হা কার করা দৈন্যদশা। আমরা হারানো মুল্যবোধের অনুসন্ধান করি এবং চর্চার মাধ্যমে সমাজে পুনপ্রতিষ্ঠিত করি। নৈতিক মুল্যবোধ এর পুন:জাগরনই পারে মুল্যবোধের অবক্ষয়ে সামাজিক ব্যাধি দুরীভূত করতে। আমরা প্রত্যেকটি বিষয়কে নিজের মত করে ভেবে এর প্রতিকারে করনীয় বিষয় নিয়ে এগিয়ে যাই তাহলে ঐ অনাকাঙ্খিত বিষয় আর চোখে পড়বে না এমনকি দেখবোও না।
অনেক কিছুইতো দেখেছি এবং দেখব কিন্তু সেই ৭৫পুর্ববর্তী মুল্যবোধ এর পুনজাগরণ ঘটানো এবং গ্রামের সেই সমাজ ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তুলতে আমাদের কাজ করতে হবে। খুব বেশীদিন নয় ২৫/৩০ বছর আগেও যা দেখেছি তা কিন্তু এখন আর নেই। সম্পুর্ণ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন হয়ে এই বিস্ফোরনমুখী ব্যবস্থা এসেছে যা মাঝে মাঝে দেখছি। তবে যদি আমার যা সত্য যা উপযুক্ত যা সৎ যা খাঁটি যা সুন্দর যা সম্মান পাবার যোগ্য, মোট কথা যা ভাল এবং প্রশংসার যোগ্য সেই দিকে আমরা মন দেই তাহলে আমাদের আগামীর পথচলা হবে নিষ্কলুষ। কিতাবের ভাষায় ছেলে তুমি তোমার পিতা-মাতার কথায় মনযোগ দাও, আর তোমার সৃষ্টিকর্তার বাক্যে পথ চল। তাহলে তোমাদের জীবনে সফলতা তোমাদের আগে আগে চলবে। আসুন আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাগের আশায় সামনে এগিয়ে চলি। শেষে একটি কথা বলি, যা সৃষ্টিকর্তা আজ থেকে প্রায় ৪হাজার পাঁচশত বছর আগেই আমাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন “ তোমাদের জন্য আমার পরিকল্পনার কথা আমিই জানি, তা তোমাদের মঙ্গলের জন্য, অপকারের জন্য নয়। সেই পরিকল্পনার মধ্যদিয়েই তোমাদের ভবিষ্যতের আশা পুর্ণ হবে।” হা আমাদের ভবিষ্যতে আশা পুর্ণ হউক আমাদের সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় ও আমাদের প্রত্যাশিত আকাঙ্খায়। আর তখনই আমাদের চোখের সামনে থেকে বিদায় হবে সামাজিক অবক্ষয় নামক ব্যধির।