বিল্লাল হোসেন, রাজগঞ্জ (যশোর) প্রতিনিধি॥ যশোরের মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ বাজারের সাথে ঝাঁপা গ্রামের যোগাযোগের মাধ্যম ছিলো নৌকা। এ দুটি গ্রামের মধ্যে ঝাঁপা বাঁওড় হওয়ায় শত শত বছর ধরে ঝাঁপা গ্রামবাসী নৌকা পার হয়ে রাজগঞ্জ বাজারে আসছেন। একইভাবে পার হয়ে স্কুল কলেজে যাতায়াত করছেন ওই এলাকার শতশত শিক্ষার্থী। গ্রামবাসীর দুর্ভোগ নিরাসনে ঝাঁপা গ্রামের ৫৬ জন যুবকের উদ্যোগে নিজেস্ব অর্থায়নে বাঁওড়ের ওপর ভাসমান সেতু তৈরি হচ্ছে।
সেতু নির্মাণের জন্য গঠন করেছেন ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করছেন এক হাজার ফুট লম্বা প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর লোহার সেতু। তবে কোন পূর্ব পরিকল্পনা নয়, হঠাৎ বুদ্ধিতেই তারা শুরু করেন কাজ। নেয়নি কোন প্রকৌশলীর মতামত। নিজেদের পরিকল্পনা দিয়েই ৮৩৯ টি প্লাস্টিকের ড্রাম, ৮শ’ মণ লোহার অ্যাঙ্গেল পাত ও ২৫০টি লোহার সিটের মাধ্যমে লোহার পাত দিয়ে একেরপর এক ড্রাম যুক্ত করে তৈরি করেছেন চার ফুট চওড়া এক হাজার ফুট দীর্ঘ সেতুটি।
বাঁওড়ের ওপর সেতু হওয়ায় খুশি ঝাঁপা এলাকার প্রায় ১৫ হাজার নারী-পুরুষ। ফাউন্ডেশনের সভাপতি মেহেদী হাসান টুটুল বলেন, ‘বছর খানেক আগে বাঁওড় পাড়ে বসে গল্প করছিলাম গ্রামের শিক্ষক আসাদুজ্জামানসহ ৫-৬ জন। তখন বাঁওড় থেকে মেশিনে বালি তোলা হচ্ছিল। যেই মেশিনটি রাখা হয়েছিল প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর ভাসমান অবস্থায়। তাই দেখে হঠাৎ বুদ্ধি আসে মাষ্টার আসাদুজ্জামানের। ড্রাম যদি ভারি মেশিন ভাসিয়ে রাখতে পারে তবে, সেতু কেন নয়? আসাদুজ্জামানের যুক্তি মনে ধরে উপস্থিত সবার। শুরু হয় গ্রামবাসীর সাথে বৈঠক, এরপর ফান্ড তৈরির কাজ।’
টুটুল বলেন, ‘চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি আমরা গ্রামবাসীর সাথে প্রথম বৈঠকে বসি। কয়েক দফা আলোচনার পর গ্রামের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত ৫৬ যুবকের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। এরপর সবাই ২০-৩০ হাজার টাকা করে জমা দিয়ে তৈরি করি তহবিল। পরে আগস্ট মাসের দিকে শুরু হয় ভাসমান সেতু তৈরির কাজ।’
টুটুল আরো জানান, যদিও সেতু তৈরিতে কোন প্রযুক্তি জ্ঞান ব্যবহার করা হয়নি। তবে আমরা উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে পরামর্শ করেছি। এমনকি জেলা প্রশাসকের দপ্তরেও কথা বলা হয়েছে। সবাই পরিবেশ বান্ধব সেতু তৈরিতে মত দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আগামী ১ জানুয়ারি সেতুটি জনগণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেয়া হবে। আগে খেয়া পারাপারের জন্য মাঝিদের গ্রামবাসী সপ্তাহে পাঁচ টাকা করে আর বছরে এক মণ করে ধান দিতে হত। একই খরচে গ্রামবাসী সেতুটি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অন্য এলাকার লোকজন যেমন টাকা দিয়ে খেয়া পার হতেন, সেতু পার হতে তাদেরকে সেই খরচ দিয়ে চলাচল করতে হবে।’ আর এই টাকা সংগ্রহ করবেন ঘাটে নৌকা চালানো সেই চার মাঝি। এতে করে মাঝিদের সংসার যেমন চলবে তেমনি উঠে আসবে সেতু নির্মাণের খরচও।
সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল, ভ্যান, নসিমন প্রাইভেট কারসহ মাইক্রোবাস পারাপার হতে পারবে বলে মত দেন তিনি।
কথা হয় নৌকায় চড়ে বাড়ি ফেরা স্কুল ছাত্র ফাহিম ও সজিবের সাথে। তারা দুইজনে রাজগঞ্জ বাজারের গোল্ডেন সান প্রি-ক্যাডেট স্কুলের ছাত্র। তারা জানায়, দুই বছর ধরে নৌকা পার হয়ে স্কুলে আসছি। প্রথমে ভয় হত, এখন হয় না। সেতু হলে আর নৌকার জন্য ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারব।
কথা হয় ঘাটের মাঝি শেখর চন্দ্রের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা ঝাঁপা গ্রামের তিনজন মাঝি নৌকায় লোক পারাপার করি। এই করে তিন পরিবারের পনের জনের পেট চলে। কমিটি বলেছে ব্রিজ চালু হলে আমাদের কাজ দেবে। ব্রিজ পার হওয়া লোকজনের কাছ থেকে আমরা টাকা তুলব। সেখান থেকে আমাদের সংসার খরচ দেয়া হবে। তাই আমাদের কোন আপত্তি নেই।’
‘তবে এই ব্যাপারে লিখিত কোন চুক্তি হয়নি, মৌখিকভাবে কথা পাকা হয়ে আছে,’বলেন শেখর মাঝি।
মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘ঝাঁপা বাওড়ের ওপর সেতু তৈরির কাজ আপনারা যেমন দেখেছেন, তেমন আমিও দেখেছি। কমিটির কেউ আমাকে বিষয়টি জানায়নি। সেতু পারাপারে গ্রামবাসীর নিজেদের মধ্যে অর্থ আদায়ের বিষয় থাকতে পারে।