কেন সেই ইন্তিফাদা, কি চেয়েছিল ফিলিস্তিন, কি পেল?

মিডলইস্ট মনিটর অবলম্বনে- তারিক মাহমুদ॥ ডিসেম্বর ১৯৮৭, আজ থেকে ঠিক ৩০ বছর আগে আজকের দিনটিতে ফিলিস্তিনের দখলকৃত এলাকা জুড়ে দাবানলের মত ছড়িয়ে পরেছিলো ইসরাইল বিরোধী কঠোর আন্দোলন। প্রথম ইন্তিফাদা। পাঁচ বছর সময় জুড়ে চলেছিলো সেই আন্দোলন। ইতিহাস স্বাক্ষী হয়েছে হাজারো ফিলিস্তিনির আত্মউৎসর্গের। তিন দশক পরেও ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রাম আজো চলছে। intifada in palaistain
প্রথম ইন্তিফাদার কথা: কি ছিল সেই ইন্তিফাদায়?
ইন্তিফাদা, এই মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি রচিত হয়েছিলো ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে, গাজায়, এবং পূর্ব জেরুজালেমের অংশজুড়ে। বিশ বছর ধরে চলা ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্বে আমরন সংগ্রাম। নির্মম হস্তক্ষেপ, কার্ফিউ, গ্রেফতার, টহল, আগ্রসন এবং আবাসস্থল ধ্বংস এহেন কার্যক্রমের মাধ্যমে ফিলিস্তিন ভূখন্ডে দখলিকৃত ইসরাইলি হানাদাররা কায়েম করেছিলো শোষণ-নিষ্পোষনের এক কালো অধ্যায়।
ডিসেম্বরের ৮ তারিখে গাজার জাবালে শরর্ণাথি শিবিরের বাইরে একটি বেসামরিক গাড়িতে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর লড়ির আঘাতে কয়েকশ মানুষের চোখের সামনে যখন চারজন ফিলিস্তিনি মারা যায়, চাপা ক্ষোভ যেন জ্বলে উঠে ক্রোধের আগুনে। যে চারজন শাহাদত বরণ করে, তাদের জানাযায় ১০ হাজারের মত শোকাচ্ছন্ন মানুষ উপস্থিতি হয়, কিন্তু সেই শোকাচ্ছন্ন দিনেই জানাযায় উপস্থিত ফিলিস্তিনিদের ঠেলে দেয়া হয় শোকের তীব্র গহ্বভরে। জানাযার জনমুদ্রের দিকে ছোড়া ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এলো-পাথারি মিসাইলে নিহত হয় ১৭ বছরের যুবক হাতেম আবু সিসি, আরমারত্বক ভাবে আহত হয় আরো ১৬ জন।
ফিলিস্তিনি নেতারা আলাপ-আলোচনার জন্যে যখন জড়সড় হতে শুরু করেছে, ততক্ষণে উতপ্ত অবস্থা আগ্নেয়গিরির মত বিস্ফোরিত হয়ে গেছে; প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের লাভা ছড়িয়ে পরেছে ফিলিস্তিনি শরনার্থি ক্যাম্প থেকে গাজার পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমের সমস্ত অঞ্চল জুড়ে। এরপর খুব দ্রুতই ফিলিস্তিনিরা দখলে নিয়ে ফেলে আশেপাশের সকল এলাকা, শুরু করে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড স্থাপন, যেন ইসরাইলি আর্মির ভারি যান-বাহনগুলো প্রবেশ করতে না পারে। কোন রকম অস্ত্রশ্স্র ছাড়াই, কেবল মাত্র প্রতিশোধ আর প্রতিরোধের আগুনে ঝলসাতে পাথরের টুকরো ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সৈন্য-সামন্ত এবং ট্যাংকগুলোর দিকে ছুড়ে দিয়ে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। ব্যবসায়িরা ব্যবসা বন্ধ করে দেয়, আর শ্রমিকরা প্রত্যাক্ষণ করে ইসরাইলের ভেতরে কারখানায় কাজ করতে।
ইসারাইলি সেনাবাহিনী এটা বরদাস্ত করতে না পেরে এই পুরো প্রতিরোধ আন্দোলনকে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে ঘোষানা দিয়ে কঠোর হাতে প্রতিরোধকারীদের শায়েস্তা করতে উত্তাল জনতার দিকে রাবার বুলেট, তাজা গুলি এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ শুরু করে। এত কিছুর পরেও প্রতিরোধ আন্দোলন আরো তীব্র এবং বৃহৎ আকার ধারণ করে, নতুন করে যুক্ত হয় লাখো মানুষ, বাদ পরেনি নারী ও শিশুরাও। ডিসেম্বরের ১২ তারিখে মধ্যে সহিংসতায় শাহাদাত বরণ করে আরো ৬ জন, গুরুতর আহত হয় ৩০ জনের মত। সর্বপরি ইসরাইলী সেনাবাহিনীর জুলুমের বিরুদ্ধে যে সকল ফিলিস্তিনি বারুদের মত প্রতিরোধের আগুনে জ্বলে উঠেছিলো তারা সকলেই ছিলো ইসরাইলি অমানবিক সামরিক শোষন-নিষ্পোষনের জানামায় বেড়ে উঠা বিক্ষুব্ধ প্রজন্মের বড় একটি অংশ, আর এমন প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহনের সুযোগ তারা হেলায় হারাতে চায়নি।
দিন যতই যাচ্ছিল আন্দোলন স্থিমিত হওয়ার কোন লক্ষনই যখন দেখা গেল না, জনসাধারণকে আন্দোলনে অংশগ্রহন থেকে বিরত করতে ইসরাইলি দখলদাররা গণগ্রেফতার কর্মসূচি নেয়। পশ্চিম তীরের বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রথম বছরেই ইসরায়িলি সরকার ১৬০০ বার কার্ফিউ জারি করে। ফিলিস্তিনিদের খামড় ও বসতভিটা গুড়িয়ে দেয়া হয়, উপড়ে ফেলা হয় গাছপালা, এবং প্রতিবাদ স্বরূপ যে সকল ফিলিস্থিনিরা ট্যাক্স দিতে অস্বিকার করে, বাতিল করা হয় তাদের সম্পত্তি ও আবাসগৃহের লাইসেন্স। বসতিস্থাপন করা অবৈধ ইহুদি সেটেলার পর্যন্ত নিয়মিত ফিলিস্তিনিদের উপরে হামলা চালাতে থাকে; আত্মরক্ষার্থে ছোড়া পাথরের জবাবে ফিলিস্তিনের কপালে জুটতে থাকে সেটেলারদের হিংস্র আক্রমন। ইউএন রিলিফ এবং ওয়ার্ক এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজির তথ্য মতে, ইন্তিফাদা সূচনার প্রথম বছরেই ৩০০ ফিলিস্তিনি শহীদ হয়, মারাত্বক আহত হয় ২০ হাজার এবং সাড়ে ৫ হাজারের মত ফিলিস্তিন কারাবরণ করে ইসরাইলি দখলদারদের হাতে।
সেইভ দ্যা চিলড্রেনের সুইডিশ শাখার হিসেব অনুযায়ি, “ইন্তিফাদা সূচনার প্রথম দুই বছরেই আঘাত জনিত জখমের কারণে ২৩,৬০০ থেকে ২৯,০০০ শিশুর মেডিকেল চিকিৎসার প্রয়োজন পরেছিলো, এদের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ শিশুরই বয়স ছিল ১০ বছরের কম।’’
স্থিরচিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলো বিশ্ববাসির সমানে নির¯্র ফিলিস্তিনি আন্দোলনকারীদের অসহায়ত্বের পাশাপাশি অস্ত্রধারী আগ্রাসি ইসরায়িলি সেনাবাহিনীর নির্মমতার চিত্র তুলে ধরতে এবং একই সাথে এটি আর্ন্তজাতিক কমিউটিনির মধ্যে ইন্তিফাদার ব্যাপারে সচেতনতাও তৈরি করতে সাহায্য করেছিলো। সুনিদৃস্ট ভাবে উল্লেখ করা যায় ১৯৮৮ তে প্রকাশিত একটি ভিডিও চিত্রের কথা, যেটিতে ইস্রাইলি এক সৈনিককে দেখা যায় দুই ফিলিস্তিনি কিশোরকে নির্মম ভাবে পেটাতে, আর পেটানোর এক পর্যায়ে উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভাবে ওই কিশোরদের হাত ভেঙ্গে দিতে; যেটি বিশ্বজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করেছিলো। শত্রুতাপূর্ণ আরব প্রতিবেশি রাস্ট্র দ্বারা বেষ্ঠিত নাজুক এক ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বব্যাপি যে ইমেজ ইসরাইলের ছিল তার বিপরীত চিত্রই ওই ভিডিওচিত্রের মধ্যে দিয়ে বিশ্ববাসির সামনে প্রকাশিত হয়েছিলো।
কি হলো এরপর?
১৯৮৮ থেকে ফিলিস্তিনি নেতারা বাড়তে থাকা এই সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে। তিউনেশিয়া সর্মথিত তৎকালিন ইয়াসিন আরাফাতের দল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্রগানাইজেশন (পিএলও) সহিংসতার লাগাম টেন ধরতে চেষ্টা করে এবং চেষ্টা করে ইউনাইটেড নেশনের সাথে যৌথ ভাবে কাজ করতে। এই প্রচেষ্টা খুব কমই সফলতার মুখ দেখে। বিপরীতে গাজা উপত্যকায় জন্ম হয় হামাসের (ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন, যারা নিজেদের ফাত্তাহ-সর্মথিত পিএলও’র বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। হামাস ফিলিস্তিনিদের প্রধান লক্ষ হিসেবে যে কোন কিছুর বিনিময় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। এই ডাক আন্দোলনরত যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করে এবং সাহস যোগায় ইসরাইলি দখলদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার, আর এখন এটাকেই পুজি করেই তেলআবিব দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনে চালিয়ে যাওয়া তাদের নিপীড়নকে বৈধতা দিয়ে আসছে।
১৯৮৮ সালে জর্দানের সুলতান হোসেন পশ্চিম তীরের সাথে সকল প্রশাষনিক এবং অর্থনৈতিক সর্ম্পক ছিন্ন করলে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীকার আন্দোলনের স্বপ্নআরো হুমকির মুখে পতিত হয়। রক্তস্রোতের ধারা অব্যাহত থাকে, সাথে সাথে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার ডাকও জোরদার হয়। একই বছরে দ্যা প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিল নামের প্রবাসি সরকার ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘের নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ি দুইরাস্ট্র ভিত্তিক সমাধন গ্রহন করে।
এতকিছুর মধ্যেও অবিরত সহিংসতা চলতে থাকে। ১৯ জনের মত ইসরায়িলি সাধারণ নাগরিক এবং ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সের ৬ জন সদস্য নিহত হয়। এদিকে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট কাউন্সিল একটানা ইসরাইলের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘন এবং ৪র্থ জেনেভা কনভেশন অগ্রাহ্য করার অভিযোগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবিত নিন্দা জানানোর খসড়া সিদ্ধান্তে ভেটো প্রয়োগ করে গিয়েছিলো।
১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্র পিএলও’কে ফিলিস্তিনের সর্বস্তরের জনগনের প্রতিনিধি হিসেবে স্বৃকিতি দেয়, তার আগ পর্যন্ত ইসরাইল এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে খুব কৌসলে মধ্যস্ততার টেবিলে আটকে রেখেছিলো। নরওয়ের আগ্রহে পিএলও এবং ইস্রাইলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে, যা পরর্বতি বছরে অলসো চুক্তিতে গিয়ে সমাপ্তি লাভ করে।
চুক্তিতে পাচ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বতিকালিন সময় নির্ধারণ করা হয়, যে সময়ের মধ্যে ইসরাইলি সেনাবাহিনী দখলিকৃত এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিবে, এবং ফিলিস্তিনি কতৃপক্ষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে সচল করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে। ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের উপস্থিতিতে ওয়াইট হাউসের লনে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী ইটজেক রবিন এবং পিএলওর চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে।
আর্ন্তজাতিক মহলের উদ্যোগে শান্তি প্রচেষ্টার অব্যাহত থাকার পরেও অবিরাম সহিংসতা চলতে থাকে। ১৯৯৩ সালে যখন ইন্তিফাদা সমাপ্তির পথে, ততদিনে ১৫০০ ফিলিস্তিনি এবং ১৮৫ ইসরাইলি নাগরিক মৃত্যুবরণ করেছে; ১ লক্ষ ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি করেছে কারাবরণ। ভুক্তভোগি ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই রকমভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা দুনিয়া জুড়ে আর্ন্তজাতিক মহলে ইসরাইলের প্রতি প্রচন্ড অনাস্থা তৈরি করে। যা পরর্বতিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিশোধে ইসরাইল প্রতি ফিলিস্তিনিদের ভূখন্ডে চলমান সহিসংতা বন্ধের দাবী জানিয়ে ৬০৭ এবং ৬০৮ ধরার প্রস্তাব উত্থাপনের মত প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলো।
ঐতিহাসিকদের চোখে যদিও ইন্তিফাদা শান্তি প্রক্রিয়া সূচনার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে আলোচিত হয়ে আসছে, কিন্তু ৩০ বছর পর এখন পর্যন্ত শান্তির সেই নিশান উড্ডিন হয়নি। এদিকে অলসো চুক্তি আরো একটি ব্যার্থ অধ্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে, ইসরাইলী অবৈধ দখলদারিত্বে ফিলিস্তিনিদের নাগরিক এবং ভৌগলিক অধিকার আগের থেকে আরো বেশি হুমকির মুখে। প্রথম ইন্তিফাদা আসলে কখনোই সমাপ্ত হয়নি, বরং ফিলিস্তিনিরা সর্বাংশে ও সব সময় জুড়েই ইসরাইলের দখলদারিত্ব, নীপিড়ন এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে করে চলছে এক অনন্ত সংগ্রাম। মিডলইস্ট মনিটরে প্রকাশিত হান্না হাসান-এর লেখা হতে অনুদিত ও সংক্ষেপিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published.