আন্তর্জাতিক॥ সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান মান্ষুকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে, যা জীবনযাপনকে করেছে সহজতর। কিন্তু বিজ্ঞানের সেই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে। প্লাস্টিক বর্জ্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ অপরিহার্য। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বিকল্প সামগ্রী হিসেবে পলিমারের ব্যবহার হচ্ছে। ক্যারি ব্যাগ থেকে ওষুধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলেব টব, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চটের ব্যাগ হোক কিংবা কাঁচের শিশি অথবা চিনেমাটির থালা কিংবা মাটির টব- এ সব কিছুরই বিকল্প হিসেব ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। অপেক্ষাকৃত সস্তা, বহনযোগ্য হওয়ার কারণে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছ পলিমারে তৈরি সামগ্রী। এর ব্যবহার নিয়ে আপত্তি নেই, কিন্তু ব্যবহারের পর যেভাবে এগুলিকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে, আপত্তি তাতেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় তারা ব্যবহার করা প্লাস্টিকের সামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না, এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে লোকালয়ের বুকে। আর তা থেকেই ছড়াচ্ছে দূষণ। পলিমার সামগ্রী পুড়িয়ে ফেললে আরও বিপদ, হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা।
আবর্জনা থেকে চোখধাঁধানো শিল্পকলা । সাগর, সচেতনতা ও শিল্প ‘ওয়াশড অ্যাশোর’ মানে যা সাগরের পানিতে ভেসে এসেছে। সেই প্লাস্টিক সংগ্রহ করার মানে সমুদ্র সৈকতকে আবর্জনামুক্ত রাখা। আবার তা থেকে এ ধরনের ভাস্কর্য সৃষ্টি করার অর্থ শিল্পকলা। ভাস্কর্যটি প্রবালদ্বীপের বাসিন্দা একটি প্যারট ফিশের- কাজেই সাগরের আবর্জনা যেন শিল্প হয়ে আবার সাগরেই ফিরে যাচ্ছে।
প্রতি বছর ভারতে ৫৬ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়। এর মধ্যে রাজধানী দিল্লি প্রতিদিন ৯,৬০০ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদন করে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কঠোর কোনো আইন ভারতে নেই। একটাই আইন রয়েছে ৫০ মাইক্রনের কম প্লাস্টিকের ব্যাগ কেউ উৎপাদন বা ব্যবহার করতে পারবে না যেহেতু তা পুনর্ব্যবহারযোগ্য হয় না। কিন্তু সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে কম মাইক্রনের সামগ্রী তৈরি হচ্ছে, যা বর্জ্য হিসেবে জমে উঠছে আমাদের পরিবেশে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি কোথায়? সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে অনেকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছেন। অনেক পরিবেশ সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের উদ্যোগে প্লাস্টিকের অভিনব ব্যবহারে উদ্যোগী হয়েছে। অনেকে একেবারে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে প্লাস্টিক বর্জ্যের মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছেন। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের উদ্ভিদবিদ্যার প্রাক্তন গবেষক সীমা মুখোপাধ্যায় তেমনই একজন।
ফেলে দেওয়া জিনিস ফেলনা নয়। এই স্লোগানকে সামনে রেখে লড়াইটা শুরু করেছেন সীমা মূলত ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ ও বোতলই জনপদের পরিবেশকে বেশি দূষিত করছে। কলকাতা ও শহরতলির যে কোনো এলাকা সফর করলে দেখতে পাওয়া যাবে, রাস্তাঘাট, নিকাশি নালা, জলাশয়ের পড়ে রয়েছে ক্যারি ব্যাগ ও বোতল। কোথাও আবার থার্মোকলের থালা-বাটি। মূলত এই জিনিসগুলিকে নিয়ে নানা ধরনের শিল্প সামগ্রী তৈরি করছেন ড. মুখোপাধ্যায়। বোতল কেটে তৈরি করছেন ফুলদানি। ব্যাগ কেটে তৈরি করছেন ফুল। শিল্প সৃষ্টি হিসেবে এই বোতল বা ফুল হয়ত বিরাট উঁচু মানের নয়, কিন্তু এর নেপথ্যে থাকা মহত উদ্দেশ্য এই সৃষ্টিকে উৎকৃষ্ট শিল্পেরও উপরে নিয়ে যেতে পারে। প্লাস্টিক দূষণ তাঁকে ভাবিয়েছে এবং হস্তশিল্পের মুন্সিয়ানায় নতুন পথ তৈরি করেছেন।
‘কোল্ড ড্রিংকসের বোতল, বাজারের ক্যারি ব্যাগ, চিপসের প্যাকেট থেকে ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করা যায়।’
নির্বাচিত প্রতিবেদন : ‘এভাবে চললে প্লাস্টিকের নীচে চাপা পড়বো আমরাই’। ভারত-বাংলাদেশে গেলে আজকাল আমি আর শান্তি পাই না, পাই না স্বস্তি। শহরের কথা তো ছেড়েই দিলাম, গ্রামে-গঞ্জে, পাহাড়ে, নদীর ধারে – যেদিকেই তাকাই, চোখে পড়ে প্লাস্টিক, যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা স্তূপাকার প্লাস্টিক, শুধুই প্লাস্টিক। (২৭.১২.২০১৬)
প্লাস্টিক বর্জ্যে বিপন্ন হচ্ছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র। মুম্বই সমুদ্রসৈকত পরিষ্কার রাখার নাগরিক প্রচেষ্টা। প্লাস্টিক দূষণ, মহাসাগরে চরম বিপর্যয়। সীমা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কোল্ড ড্রিংকসের বোতল, বাজারের ক্যারি ব্যাগ, চিপসের প্যাকেট থেকে ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করা যায়। আমি বাড়িতে প্রথমে তৈরি করলাম। তারপর সেটাই স্কুলে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের দেখিয়েছি। আমার হাতে থাকা কথা-বলা পুতুল তাদের বুঝিয়েছে, কেন এটা করতে হবে।’’
ভারতের বিপুল জনসংখ্যার বিচারে এ ধরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ বা প্রচারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমা মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিগত বা ছোট সংগঠনের স্তরে এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যা আদৌ পর্যাপ্ত নয়। তাই পরিবেশকর্মী ও বিজ্ঞান সংগঠনের সদস্যরা মনে করছেন, এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা দরকার।
হুগলি জেলার কোন্নগরের সংগঠন যুক্তিমন-এর সদস্য মৌসুমী মুন্সী বলেন, ‘‘গণমাধ্যম এগিয়ে না এলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে প্লাস্টিকের কুফল তুলে ধরা যাবে না। আগামী ১২ থেকে ১৫ জানুয়ারি আমাদের বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি বছর বহু মানুষ এই মেলায় আসেন। কিন্তু বছরভর এই প্রচার চালানোটা জরুরি। শুধু কয়েকদিনের মেলা বা কর্মশালা করে সচেতনতার প্রসার ঘটানো যাবে না।”
সীমার আক্ষেপ, অনেকক্ষেত্রেই তাঁর উদ্যোগ হাতের কাজ শেখার কর্মশালা হয়ে থেকে যায়। কেন প্লাস্টিক দিয়ে এ সব তৈরি করছি, সেই চেতনাটা সব ক্ষেত্রে জাগানো সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, ‘‘চেতনা প্রসারের জন্য সরকারি স্তরে বড় ধরনের উদ্যোগ দরকার। না হলে ব্যক্তিগত চেষ্টায় বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়।”
এ ব্যাপারে অবশ্য একটা ভালো খবর শুনিয়েছেন সীমা। জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী হুগলী নদীর তীরবর্তী পুরসভা এলাকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য নিষ্কাশনের কথা ভাবছে। জানুয়ারিতে দু’পক্ষের বৈঠক হবে। সীমার মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ চালিয়ে যাওয়া নাগরিকরা পুরসভার দলকে এই সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেবেন।
কিন্তু এ সব উদ্যোগ নিতে আমাদের একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো? পৃথিবীর মাটি, বাতাস, প্রাণী ও উদ্ভিদ প্লাস্টিক দূষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীর তিন ভাগ জল ও তাতে থাকা জলজ প্রাণী-উদ্ভিদ। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, যেভাবে দূষণ বাড়ছে তাতে ২০৫০ সালে সমুদ্রে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের সংখ্যা বেশি হবে। এর মোকাবিলা কীভাবে হবে, তা নিয়ে নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। এর মধ্যেই খবর মিলেছে, অ্যামেরিকায় আগামী এক দশকে প্লাস্টিকের উৎপাদন বাড়বে ৪০ শতাংশ। কোথায় যাবে এই বিপুল বর্জ্য? এ যেন গোটা পৃথিবীর দূষিত আস্তাকুঁড় হয়ে ওঠার অশনিসংকেত!
সত্যিই তো, কোথায় যাবে এ সব বর্জ্য? জানান আপনার মন্তব্য, নীচের ঘরে।
নির্বাচিত প্রতিবেদন: প্লাস্টিকের ব্যাগ কি শুধুই ব্যাগ? বাজার করার জন্য একবার ব্যবহার করা যায়, এমন প্লাস্টিকের ব্যাগ হামেশাই দেখা যায় যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ‘ওয়ান-টাইম’ প্লাস্টিক ব্যাগের জায়গায় সুতি, চট বা কাগজের ব্যাগও হতে পারে। ছবিঘরে কিছু ব্যাগের নমুনা দেখুন! (২৪.০১.২০১৪)
আবর্জনা দিয়ে তৈরি স্কুল । কাম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনে প্রতিদিন যে পরিমাণ আবর্জনা সৃষ্টি হয়, তা দেখে উক ভ্যান্ডে শুধু আবর্জনা দিয়ে একটি স্কুল তৈরি করার পরিকল্পনা করেন। (২৭.০৭.২০১৭)
আবর্জনা থেকে চোখধাঁধানো শিল্পকলা : যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন রাজ্যের সমুদ্রসৈকতে যে সব ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের টুকরো ভেসে আসে, তা জুড়ে জুড়ে সাগরের জীবজন্তুর মূর্তি গড়েন ‘ওয়াশড অ্যাশোর’ প্রকল্পের শিল্পীরা। (৩১.০৭.২০১৭) ‘কোল্ড ড্রিংকসের বোতল, বাজারের ক্যারি ব্যাগ, চিপসের প্যাকেট থেকে ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করা যায়।’