ইসরাত জাহান লাকী, আন্তর্জাতিক ডেক্স॥ তাঁকে দেখামাত্র বাঙাল ভাষায় বিচিত্র সম্বোধনে ঋত্বিক ঘটক বলে উঠেছিলেন, “অ্যাই ছেমড়ি, একটা ছবি করতাসি ‘চেনা মুখ’ গল্প নিয়া। তর লিগা একটা পার্ট আছে ‘নীতা’। সব কাম প্যাক-আপ কইরা দশ দিনের লাইগা শিলং চল…” নিজের চোখ কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না সুপ্রিয়া। পরেরটা ইতিহাস।
কি ছিল সেই কাহিনী সংক্ষেপ : ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে এই ধ্রুপদী চলচ্চিত্রটি। নীতা ও তার পরিবার পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে দেশ বিভাজনের কারণে কলকাতা ঠাঁই নেয়। নীতার মতো এ রকম অসংখ্য হিন্দু পরিবার ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাজনের দায় মাথায় নিয়ে শরণার্থী হয়েছে।
কলকাতার শহরতলীর এক প্রান্তে এই শরণার্থী পরিবারটিকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে নামে পরিবারের বড় মেয়ে নীতা। পড়ালেখা শেষ না করেই সে কাজের জন্যে ঘুরতে থাকে। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা, বড় ভাই শংকর সংসারের ব্যাপারে উদাসীন, গান-বাজনা নিয়েই ব্যস্ত । কাজেই নীতাকেই সব দায়িত্ব মাথায় নিতে হয়, সেই চালায় গোটা সংসার, নিজেকে ভুলে ।
একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। বড় ভাই শংকর সংগীত শিল্পী হওয়ার আশায় চলে যায় কলকাতা, প্রেমিক সনৎ তাকে রেখে তারই ছোট বোন গীতাকে বিয়ে করে, নীতার চাকরীও একসময় চলে যায় এবং সবশেষে সে নিরারোগ্য যক্ষায় ভূগতে থাকে। চাকরী, প্রেম, স্বাস্থ্য সব হারিয়ে নীতা যখন রিক্ত তখন বড় ভাই শংকর ফিরে আসে, ইতোমধ্যে ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে সে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছে, তার আর্থিক অবস্থায় ফিরেছে, বিয়ে করে সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার । ভাই একসময় বোনকে দেখতে গেলে নীতা ভাই র কাছে শেষ সময়ে বেঁচে থাকার আকুতি জানায়। আমরা শুনি সুপ্রিয়া দেবীর সেই অমর উক্তি, ”দাদা আমি বাঁচতে চাই” !
বাবা-মা দুজনই বাংলাদেশের। ‘আমার মামার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে আর ফরিদপুরের নড়িয়ায় (বর্তমান শরীয়তপুর) বাবার বাড়ি।’ ‘জন্মেছি বার্মায়। শহরটার নাম মেকিনা। আমাদের সব ভাইবোনের জন্ম সেখানেই। বাবা ছিলেন আইনজীবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা কলকাতায় চলে আসি। এখনো মনে আছে, অনেক রাস্তা হাঁটতে হয়েছিল’’। এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়ে আবার শুরু করা, খাপ খাওয়ানো, ধীরে ধীরে সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে শিল্পী জীবনে প্রতিষ্ঠা একেবারেই সহজসাধ্য ছিলোনা, সেসব কাহিনী খুব কম ই লেখা থাকে !
মাত্র সাত বছর বয়সে অভিনয়ের জগতে পা রাখেন সুপ্রিয়া। তিনি দুটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন, তাঁর বাবার নির্দেশনায়। ছোট থেকে নাচ খুব ভালবাসতেন অভিনেত্রী। তাঁর নাচ এতটাই ভালছিল যে, তৎকালীন বর্মার প্রধানমন্ত্রীর থাকিন নুর থেকে পুরষ্কৃতও হন প্রয়াত অভিনেত্রী। কলকাতায় এসেও নাচ চালিয়ে যান সুপ্রিয়া দেবী। সেসময় তাঁদের প্রতিবেশী ছিলেন চন্দ্রাবতী দেবী । তিনিই তাঁর পরিচিতি ব্যবহার করে বাংলা সিনেমার জগতে নামার সুযোগ করে দেন সুপ্রিয়া দেবীকে।
বাংলা ছবির স্বর্ণকালের অভিনেত্রী হয়েছিলেন সুপ্রিয়া, দর্শকদের মনে জায়গা জুড়ে ছিলেন উত্তম- সুপ্রিয়া জুটিও । উত্তম ছাড়াও সুপ্রিয়া দাপট দেখিয়েছেন ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহা , মৃনাল সেনের ছবিতে, নিজের অভিনয় ক্ষমতার প্রকাশ দেখিয়েছেন মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার সহ অনেক ছবিতে, ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা কিংবা ‘দেবদাস’–এর চন্দ্রমুখী, বা ‘দুই পুরুষ’-এর বিমলা অথবা ‘বন পলাশীর পদাবলী’র পদ্মা বাংঙালী হৃদয়ে থাকবে অমলিন ! তাঁর প্রাপ্তির ঝুলিতে, দুবার বাংলা ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশ থেকে সম্মাননা । ২০১১ সালে বঙ্গ বিভূষণ সম্মানে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। ২০১৪ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে তাঁকে সম্মানিত করে কেন্দ্রীয় সরকার।
উত্তম কুমার নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন গৌরী দেবীকে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানসিক দূরত্ব বাড়তে থাকে দুজনের । বিয়ে হয়েছিল সুপ্রিয়া দেবীর বিশ্বনাথ চৌধুরীর সাথে, বিয়ের কয়েক বছর পর তাঁর একটি কন্যা সন্তান হয়। সেসময় কয়েক বছরের জন্যে ছবির জগৎ থেকে বিরতি নেন সুপ্রিয়া চৌধুরী। তারপর ফের তিনি ফেরেন বড় পর্দায়। সম্পর্কের টানা পোড়েন শুরু হয় তারও !
ব্যক্তি জীবনের শূন্যতা থেকে জন্ম নেয় ভালোলাগা দুজনের এবং গড়ে ওঠে গভীর ভালোবাসার নির্ভরতা । কোনো লুকোচুরি ছিলোনা, লোকনিন্দা, অপবাদকে উপেক্ষা করে ১৯৬৩ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর গিরীশ মুখার্জি রোডের পৈতৃক বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসেন উত্তমকুমার । চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ময়রা রোডের ফ্ল্যাটে। জীবনের শেষ ১৭ বছর থেকে গেছেন সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতেই মহানায়ক উত্তম কুমার, আইনত বিয়ে করতে পারেননি কিন্তু মালাবদল করে বিবাহিত দম্পতির মতোই পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন তাঁরা। উত্তম স্ত্রী গৌরী দেবীর সঙ্গে আইনগতভাবে বিচ্ছেদ না হওয়ায় তারা বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারেননি ।
এখনকার সমাজের খুব কম মানুষই এই ধরণের সম্পর্ককে সম্মান দিতে জানে বা পারে, তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারী হিসাবে সুপ্রিয়া দেবীকে কি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তা সহজেই আমরা সবাই অনুমান করতে পারি। তারপরেও সকলের কাছে সুপ্রিয়া দেবীর প্রশংসা, তাঁর হাতের রান্নার প্রশংসা উত্তমকুমার যেমন খোলাখুলি করে গেছেন, ঠিক তেমনি সুপ্রিয়া দেবীও সমাজের রক্ষণশীলতা ভেঙে তিনি তাঁর ভালোবাসার কথা লিখে বলে প্রকাশ করেছেন, বলেছেন আমরা নিজেরা জানতাম আমরা মেন্টালি ম্যারেড, সবার আগে মন কথা বলে। সেটাই তো রায় দিয়ে দিয়েছিল । যদিও সুপ্রিয়া দেবী নিজেও জানতেন এবং উত্তমকুমারকে বলেওছিলেন, তুমি আমার প্রাণ, তোমাকে আমি যতই ভালোবাসি না কেন সমাজের চোখে আমি খলনায়িকা হিসাবেই পরিচিত থাকবো”!
উত্তম যেমন খুব রোমান্টিক ছিলেন এবং তেমনি ছিলেন কখনও কখনও বেশ ঈর্ষাকাতর। উত্তম কুমারের বারণ মেনেই হিন্দি ছবির জগত ত্যাগ করেন সুপ্রিয়া দেবী । বাড়িতে প্রযোজক ও পরিচালকদের বেশি আসা-যাওয়া এবং সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে তাদের আড্ডা একেবারেই পছন্দ করতেন না তিনি। ”কথাপ্রসঙ্গে উত্তমকুমারকে রেগে বললাম, ”তোমার যা অ্যাটিচিউড, একটা মদ্দা মাছিও বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। এক প্রস্ত ঝগড়া হলো, তার পর দু’জনেই জোর হাসলাম”।
প্রিয় বান্ধবী” সিনেমার সেটে উত্তমকুমারকে জড়িয়ে ধরে সুপ্রিয়া দেবীকে একটু ইর্ষান্বিত করতে চেয়েছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন, তাঁর নিজের ভাষাতে, ‘’হাসতে হাসতে এটা একটু মজা করা আরকি । বেনু (সুপ্রিয়ার ডাক নাম ) ভালো মেয়ে । ও জানে আমার আর উতুর (উত্তমের) সম্পর্ক। তাই রাগ করার প্রশ্নই ওঠে না । না হলে আমি কি একদিন ওকে ফোন করে বলতে পারতুম, উতুকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে ? অথচ উত্তমকুমারের সঙ্গে মনোমালিন্যও হয়েছে সম্পর্ক গভীর হলেই না এটা হয় । কারণ, প্রত্যাশার পারাটা ঊর্ধ্বগামী থাকে । তাই টানাপোড়েন আসতেই পারে ’।
সুচিত্রা সেন সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, তখন আমার উনিশ-কুড়ি বছর বয়স। শেওড়াফুলির একটা হলে উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম। ১৯৫৪ সালের কথা। সেই সময় এই ছবিটিকে নিয়ে দর্শকদের মধ্যে বিরাট উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। হলের বাইরে প্রচন্ড ভিড়। টিকিটের জন্য হাহাকার। আমার সঙ্গে লোক ছিল। কোনো রকমে দু-তিনটে টিকিট জোগাড় করে ছবি দেখলাম। বেশ ভালো লেগেছিল ‘অগ্নিপরীক্ষা’। এরপর বেশ কিছুদিন উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিসিজম আমাকে একেবারে ঘিরে রেখেছিল। রমাদির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সিথির মোড়ে এমপি স্টুডিওতে। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন পরিচালক নির্মল দে। নির্মলদার ‘বসু পরিবার’ ছবিতে আমি প্রথম কাজ করেছিলাম।
ভদ্রমহিলার সৌন্দর্যের থেকে ব্যক্তিত্বই আমাকে আকর্ষণ করেছিল বেশি। এরপর ধীরে ধীরে তার সঙ্গে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। তাকে আমি রমাদি বলেই ডাকতাম, আমাদের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে রমাদি কতবার এসেছে! আমরা তিনজন একসঙ্গে লাঞ্চ করেছি, ডিনার করেছি, আড্ডা মেরেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। রমাদির বাড়িতেও গিয়েছি। রমাদির জন্মদিনে প্রতিবছর উত্তম ও আমি নিয়ম করে তাকে ফুল পাঠাতাম। এমন একটা বছরও হয়নি, রমাদির জন্মদিনে আমি উইশ করিনি”।
”আমার মা বাংলাদেশের মেয়ে । তাঁর রান্নার হাত কিন্তু চমৎকার ছিল। অনেকেই বলেন, আমিও নাকি মায়ের মতোই রাঁধতে পারি। উত্তমকুমারও আমার রান্নার ভীষণ ভক্ত ছিলেন । সব খাবারই ভালোবাসতেন, বেশি পছন্দ করতেন পোস্ত। আমার হাতের খাবার খেয়ে বলতেন, “মোটা হয়ে যাচ্ছি, মোটা হয়ে যাচ্ছি।”
সুপ্রিয়ারও জীবনে আর কোনো প্রেম আসেনি । ১৯৮০ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর থেকে উত্তমকুমারের ছবিতে মালা দিয়েই জীবনের শেষ দিন পার করে গেলেন সুপ্রিয়া দেবী ।
জন্মান্তরে বিশ্বাস ছিলোনা সুপ্রিয়া দেবীর, চিরবিদায় নিয়েছেন ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস ২৬ শে জানুয়ারী , তাঁর নিজের ভাষাতে, ” জীবন একটাই । তার পর সব শেষ । আর সেটা খুব নির্মমও। তুমি যা দিলে টিলে, এখনই যদি পেলে তো পেলে । পরে কেউ মনে রাখবে না । শক্তি সামন্ত খুব বলতেন, “রাত গ্যায়ী , বাত গ্যায়ী” .. (অর্থাৎ রাত পার হলো কথাও ফুরালো)।