শীঘ্রই বিএনপির স্লোগান হবে “দুনিয়ার দুর্নীতিবাজ এক হও”

টিআইএন॥ দেশের বর্তমান রাজনীতিতে প্রধান দুটি আলোচিত বিষয়ের একটি হলো আগামী আট ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হতে যাওয়া খালেদা জিয়ার মামলার রায়। অন্যদিকে রায় ঘোষণার আগে তড়িঘড়ি করে বিএনপি তাদের গঠণতন্ত্র সংশোধনের বিষয়টিও রাজনীতিতে মুখরোচক মন্তব্য করার সুযোগ দিয়েছে। রায় ঘোষণার আগেই রায় নিয়ে দলটির হুংকারে একদিকে যেমন সরকার সতর্ক থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে তেমনি গঠণতন্ত্র সংশোধনে ও রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে কড়া মন্তব্য করার সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে কাঁঠালের আঠার মতো ছাড়াতে গিয়ে যেন আরো বেশি করে আঠায় জড়িয়ে যাচ্ছে বিএনপি। এতো গেল রাজনৈতিক দিক। কিন্তু বিএনপির এ দুটো বিষয় রাষ্ট্রীয় আইন কীভাবে দেখে? সেই কৌতূহল থেকেই নেওয়া হয়েছে এ সাক্ষাৎকার। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধ, জামাত- বিএনপির রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ও মৌলবাদ সংশ্লিষ্ট নানা সাহসী মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বার বার আলোচনায় এসেছেন। এবারো বিএনপির এদুটি আচরণের আইনী ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছি এ বিশেষজ্ঞের কাছে।  torin afroz
প্রশান্তি: ৮ই ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে দেশে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঠিক সেই সময়ে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রকাশিত একটি রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয় এতিমখানার ঠিকানা নিয়ে। খালেদা জিয়ার পক্ষে নিযুক্ত কোনো আইনজীবী ও সেই এতিম খানার ঠিকানা জানাতে পারেন নি। একজন আইনজীবী হিসেবে বিষয়টিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: প্রথমত, বিএনপি এ মামলাটিকে নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। খোদ বিএনপির মধ্যেও এ বিষয়টি নিয়ে বিরাজমান অস্থিরতা জনগণকে চিন্তিত করে তুলছে। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলটি আইনের শাসনের প্রতি আস্থা বা শ্রদ্ধাশীল কিনা তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে লম্বা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচার কার্যক্রম এখন প্রায় শেষের দিকে যখন এসেছে। অর্থাৎ রায়ের দিন ধার্য করেছেন আদালত তখনই দলের নেতাকর্মীরা বিচারাঙ্গনের বিষয়কে রাজপথে টেনে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা শুরু করেছেন। রায় বিপক্ষে গেলে মেনে না নেওয়াসহ তীব্র আন্দোলনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। তাহলে এতদিন ধরে বড় বড় আইনজীবীদের মাধ্যমে মামলাটির আইনি মোকাবেলা করার পর রায় ঘোষণার প্রাক্কালে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছেন? তবে কি বিএনপি আইনের শাসন বা আদালতের প্রতি আস্থা-শ্রদ্ধা হারিয়েছেন? সে প্রশ্ন কিন্তু এসেই যায়। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা অর্থাৎ যারা কিনা এই মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন, মামলার বিষয়বস্তু আলোচনা-পর্যালোচনা করে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। এতিমখানার ঠিকানা তাদের নিশ্চয়ই জানার কথা। এখন তারা যদি এতিমখানার ঠিকানা না জেনে মামলা পরিচালনায় এসে থাকেন তবে আইনজীবী হিসেবে এটা সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলে আমি মনে করি। এছাড়া সত্যিই যদি এতিমখানার অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে তো এই কেলেঙ্কারি পুকুর চুরি, সাগর চুরিকে ছাপিয়ে কাজির গরুর গল্পে রূপ নিচ্ছে। যেন কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই। অস্তিত্বহীন এতিমখানার নামে অর্থ গ্রাস করে নেওয়ার এই ঐতিহাসিক দুর্নীতি দেশ-জাতি এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিদর্শন হয়ে থাকবে। এই দলটি একাধিকবার দেশ পরিচালনা করেছে। যদি জনগণ আবার কখনও চায় যে দলটি সরকার গঠন করুক, তাহলে জনগণের কাছে এই দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তাদের কী উত্তর থাকবে? একই সঙ্গে এই মামলার সঠিক সুরাহা না হলে জনগণের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবেন?
প্রশান্তি: বিএনপি বরাবরই অভিযোগ করে আসছে এই মামলা সাজানো, ভিত্তিহীন। মূলত ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার এবং রায়ের ক্ষেত্রেও সরকার আদালতকে প্রভাবিত করবেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: তারা যে অভিযোগ করছেন এটা আওয়ামী লীগের সাজানো মামলা কথাটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। এ মামলা কিন্তু আওয়ামী লীগ করেনি। এ মামলা কখন হয়েছে এবং কারা করেছে এটা সারাদেশের মানুষ জানেন। কথার কথা হিসেবেও যদি ধরে নেওয়া হয় এই মামলা সাজানো তবে খালেদা জিয়ার বিজ্ঞ আইনজীবী কী করেছেন? মামলা যদি মিথ্যাই হয়ে থাকে তবে তাঁর (খালেদা জিয়া) আইনজীবীরা প্রসিকিউশনের আনা অভিযোগগুলোর প্রতিটা পয়েন্টে সন্দেহের উদ্রেক তৈরি করতে পারলেন না কেন? উল্টো এতিমখানার অস্তিত্ব, অবস্থান বা ঠিকানা যা-ই বলিনা কেন তা নিয়ে বিজ্ঞ আইনজীবীদের অজ্ঞতা নতুন সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এতিমখানাটি আদৌ আছে কি-না এবং থাকলে সেটা কোথায়? সুতরাং অহেতুক আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে আইনের যুক্তি, তথ্য, সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না।
প্রশান্তি: নির্বাচনের বছর বলে তড়িঘড়ি করে এ মামলার রায় দেওয়া হচ্ছে, বিএনপি’র এমন অভিযোগ নিয়ে আপনার বক্তব্য কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: তড়িঘড়ি! ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর সময়কে কোনোভাবে কি তড়িঘড়ি বলা যায়? আসলে তারা কি বলতে চান তা বোধগম্য নয়। উনারা কি আজীবন দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে থাকতে চান, নাকি এই ভেবে ভয় হচ্ছে যে রায়ে ওনাদের অপরাধ প্রকাশ্যে চলে আসবে? আর নির্বাচনের বছরের কথা তুললে তো বলতেই হয় এই তড়িঘড়ি বরং তাঁদের জন্য ভালো হচ্ছে। জানিনা আদালত কি রায় দেবেন তবে আদালতে যদি প্রমাণ হয় তিনি অপরাধী নন তাহলে নির্বাচনের বছরে দলের জন্য এর চেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট আর কী হতে পারে?
প্রশান্তি: সম্প্রতি বিএনপির তাদের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনেছে। বিষয়টি কে কিভাবে দেখছেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: দেখুন এই পরিবর্তনের ফলে বিএনপি দুর্নীতিবাজদের অভায়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তাদের পরিবর্তন দেখে মনে হয়েছে তারা দুর্নীতিবাজদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্যই এই পরিবর্তন এনেছেন। যখন প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা মিন্টু পরিবারের সদস্যকে তাদের মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করলো তখনই বিষয়টি অনুমেয় হচ্ছিল। কিন্তু এখন গঠণতন্ত্রে পরিবর্তনের পর তাদের অবস্থান দিবালোকের মত পরিষ্কার। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর শেষ লাইন “দুনিয়ার মজদুর এক হও” আদলে খুব শীঘ্রই বিএনপির স্লোগান হবে “দুনিয়ার দুর্নীতিবাজ এক হও”।
প্রশান্তি: আপনার জন্য শুভকামনা।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: আপনাকেও ধন্যবাদ। প্রশান্তি পত্রিকার প্রিন্টিং ও অনলাইনের সকলের জন্য শুভেচ্ছা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.