প্রশান্তি আন্তর্জাতিক ডেক্স॥ গত পাচ বছর ধরে পশ্চিমা মিডিয়ায় তুরস্ক বিরতিহীন শিরোনাম হয়েছে। অন্যান্য ইস্য থাকলেও পশ্চিমা মিডিয়ায় ঘুরে ফিরে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বকে বারবার ‘স্বৈরাচার নেতৃত্ব’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এরদোগানকে নিয়ে সৃষ্ট এই বিতর্ক ব্যাপক প্রচারনা পায় ২০১৩ সালের তুরস্কে গাজি পার্ক বিদ্রোহের সময়। ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যত করতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ব্যর্থ ক্য প্রচেষ্টার সময়ে পশ্চিমা মিডিয়া আরো আক্রমনাতœক হয়ে ওঠে।
ক্র্যু ব্যর্থ করে দিয়ে তুর্কি জনতার উল্লাস সে সময় তুরস্কের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ইউরোপ সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৭ সালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তুরস্কে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় ইউরোপ তুরস্কের সাথে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। তুরস্কে বসবাসরত আমেরিকান ধর্মযাজক এন্ড ব্রানসনের গ্রেফতার নিয়ে দেশটির ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে আমেরিকান মিডিয়ায় উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছে।
আমেরিকান ধর্মযাজক এন্ড ব্রানসন আমেরিকা ও তুরস্ক এক সাথে মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতায় এরদোগানবিরোধীরা দুই দেশের মধ্যকার কৌশলগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পকের পতন হয়েছে ইঙ্গিত করে উল্লাস প্রকাশ করে। তারা দাবি করেন, তুরস্ক ও আমেরিকার শত্রু এখন এক নয় এবং দেশ দুটির আগ্রহ ও অগ্রাধিকারে পার্থক্য বিদ্যমান। তুরস্ককে আর আমেরিকার বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কিছু আলোচক পশ্চিমা বিশ্ব থেকে তুরস্কের দূরে সরে আসার চিত্র অংকন করে চলেছেন। যেমন আমেরিকার ‘কাউন্সিল অফ ফরেইন রিলেশনস’ এর বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হাস মন্তব্য করেছেন, উদার গণতান্ত্রিকতা থেকে দূরে সরে আসা এবং নিজের মন মতো পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করায় তুরস্ক আর পশ্চিমের অংশ নয়। তিনি আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আহ্বান জানিয়েছেন; এরদোগানের শাসন পর্যন্ত তুরস্কের সাথে নিরাপত্তা ইস্যতে দরকষাকষিতে না যেতে। এরদোগান বিদায় নিলে নতুন তুরস্ক প্রশাসনের জন্য অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছেন রিচার্ড হাস। তুরস্কবিরোধী কিছু ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা এখনো ভাবছেন ট্রাম্প কর্মকান্ডের পরেও পশ্চিমাদের ঐক্য অটুট রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে তুরস্কের অর্থনীতিতে আঘাত করায় ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্স যে প্রতিবাদ জানিয়েছে তার সমালোচনা করছেন এই বুদ্ধিজীবীরা। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টি চেয়ারপারসন এন্ড নাহলস তুরস্কের পক্ষে মন্তব্য করায় এই বুদ্ধিজীবীরা তুর্কি প্রেসিডেন্টের জার্মান সফর বাতিল করতে আহ্বান করেছেন। প্রথম থেকেই তারা চেয়েছেন, এরদোগানের ব্যাপারে মেরকেল পশ্চিমা নীতির আলোকে পদক্ষেপ নিবেন। দুঃখজনকভাবে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরোধীরা বুঝতে পারেননি যে, তথাকথিত ‘পশ্চিমা জোট’ ভেঙে যেতে বসেছে। তারা বুঝতে চাচ্ছেন না যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তুরস্কের ওপর পদক্ষেপ ইউরোপকে নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলবে। ‘আমেরিকা সবার আগে’ এই স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যা ইউরোপকে নতুন বাস্তবতার মধ্যে ফেলে দিযয়েছে। কারণ ট্রাম্প ন্যাটোর সমালোচনা করে চলেছেন, ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করেছেন, শুল্ক বৃদ্ধিসহ নানান কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপৎ নিচ্ছেন ডোনাল্ট ট্রাম্প নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিতে আমেরিকার ওপর নিভরশীলতা কমানো ছাড়া ইউরোপীয় নেতাদের আর কোন বিকল্প নেই। পূবের সকল দৃষ্টিভঙ্গি ট্রাম্প প্রশাসন ভেঙে দিয়েছে। ফলে যার যার স্বার্থে ইউরোপীয় নেতাদের নিজেদের প্রতি যতœশীল হতে হবে। গত কয়েক মাসে জেরুজালেম, ইরান, সিরিয়া, শরণার্থী এবং তুর্কি ইস্যতে আমেরিকার সাথে দ্বিমত করেছে ইউরোপ। অর্থনৈতিক ক্ষতি হওয়ায় ইউরোপীয় কোম্পানির ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার বিরোধীতা করেছে ইউরোপীয় সরকারগুলো। এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমেরিকার অবরোধের জবাবে অর্থ পরিশোধের আন্তর্জাতিক নতুন পদ্ধতি চালু করার আহ্বান করেছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিকো মাস।
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিকো মাস একই সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে চার বছর পর জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ইউক্রেন, সিরিয়া ও রিফিউজি বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
ভ্লাদিমির পুতিন ও অ্যাঙ্গেলা মেরকেল অন্যভাবে বলা যায়, ইউরোপের স্বার্থ রক্ষায় জার্মান চ্যান্সেলর তুর্কি ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। এটা স্পষ্ট যে আমেরিকার ও ইউরোপের মধ্যকার ট্রান্সলান্টিক জোটের সম্পর্ক উদ্বেগের মধ্যে পড়ে গেছে। নিরাপত্তা ও অন্যান্য ইস্যতে আমেরিকার সাথে ইউরোপীয় দেশগুলো আগের মতো ভরসা করতে পারছে না। সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে আমেরিকা আরো সমস্যা সৃষ্টি করছে। পশ্চিমা জোটের অনর্থক বকবকানি উপেক্ষা করে এখন দেখা দরকার কীভাবে তুর্কি ও ইউরোপীয় দেশগুলো একে অপরকে সাহায্য করতে পারে।
বুরহানেতিন দুরান লেখক: বুরহানেতিন দুরান, তুরস্কের রাজনীতি বিশ্লেষক। জনপ্রিয় তুর্কি পত্রিকা ডেইলি সাবাহয় What Western alliance শিরোনামে প্রকাশিত কলাম থেকে অনুবাদ করেছেন লতিফুর রহমান।