মেহেদী হাসান॥ মৃত্যুর পরে আত্মার জগত সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো নিম্নে।
১। আত্মা কি?: আত্মা বা স্পিরিট হলো এক প্রকার শক্তি। যার কোনো বিনাশ নেই।
বিজ্ঞানও শক্তির অবিনশ্বরতা সম্পর্কে বলে, ‘শক্তির কোনো ক্ষয় নেই। কেবল অবস্থানের রূপান্তর আছে মাত্র।’ ঠিক তেমনি ভাবে আত্মাও এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে স্থানান্তরিত হচ্ছে। আত্মা হলো প্রানীদেহের মূল চালিকাশক্তি, হোক তা মানুষ বা অন্য প্রাণী। দেহে যতক্ষণ আত্মা থাকে, ততক্ষণ দেহ সচল থাকে। যখন আত্মা দেহ থেকে বের হয়ে যায়, তখন দেহ অচল এবং মূল্যহীন হয়ে পরে।
২। ইসলামের দৃষ্টিতে রুহ বা আত্মার অবস্থান:
মৃত্যু মানুষের জীবনের এক অনিবার্য সত্য। যার সৃষ্টি আছে তার বিনাশ আছে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন-
كُلُّ نَفْسٍ ذَآىِٕقَةُ الْمَوْتِ
প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। (সূরা আল- ইমরান,আয়াত: ১৮৫, সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫, সূরা আনকাবুত, আয়াত: ৫৭ ) পবিত্র কোরআন-হাদীসে স্পষ্ট বলা রয়েছে। মৃত্যুর পরের সময়টিকে পরকালের মধ্যে গণ্য করা হলেও পবিত্র কোরআন-হাদীসে মৃত্যু ও বিচারের দিনের মধ্যবর্তী সময়কে আলমে বরযখ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন যে-
‘এবং তাদের পেছনে রয়েছে বরযখ- যার সময়কাল হচ্ছে সেদিন পর্যন্ত যেদিন তাদেরকে পুন:র্জীবিত ও পুনরুত্থিত করা হবে।’ (সূরা মুমিনুন-১০০)
উক্ত আয়াতে যে বরযখ শব্দের ব্যবহার হয়েছে, তার অর্থ হলো যবনিকা পর্দা। অর্থাৎ পর্দায় আবৃত একটি জগৎ। যেখানে মানুষের মৃত্যুর পর থেকে আখিরাতের বিচারের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের রুহ বা আত্মা অবস্থান করবে। ইসলামে পাঁচটি জগতের কথা উপস্থাপন করেছে। প্রথম জগৎ রুহ বা আত্মার জগৎ- যা আলমে আরওয়াহ্নামেও পরিচিত। দ্বিতীয় জগৎ হলো মাতৃগর্ভ- যাকে আলমে রেহেম নামে অভিহিত করা হয়। তৃতীয় জগৎ হলো আলমে আজসাম বা বস্তুজগৎ- অর্থাৎ এই পৃথিবী। চতুর্থ জগৎ হলো আলমে বরযখ বা মৃত্যুর পর থেকে আখিরাতের বিচারের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যে জগৎ রয়েছে, যেখানে মানুষের আত্মা অবস্থান করবে। পঞ্চম জগৎ – আলমে আখিরাত বা পুনরুত্থানের পরে অনন্তকালের জগৎ।
মৃত্যুর পরে আত্মার অবস্থান :
এ কথা স্পষ্ট যে, রুহ বা আত্মার বিনাশ নেই। মৃত্যুর পর আত্মা পৃথিবী থেকে আলমে বরযখে স্থানান্তরিত হয়। অর্থাৎ আত্মা কেবল দেহ ত্যাগ করে মাত্র, তার মৃত্যু হয় না। আলমে বরযখের বিশেষ সেই অংশের নামই হলো কবর যা এক অদৃশ্য সুক্ষ্ম জগৎ। যা মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি ও কল্পনার অতীত। মূল বিষয় হলো মৃত্যুর পর মানুষের দেহচ্যুত আত্মাকে যে স্থানে রাখা হবে সেটাই তার কবর। অর্থাৎ মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে আখিরাতের পূর্ব পর্যন্ত যে অদৃশ্য জগৎ রয়েছে, সেই জগতকেই আলমে বরযখ বলা হয় যাকে আত্মার কবর বলা হয়।
আলমে বরযখে মানুষের আত্মাকে রাখার দুইটি স্থান রয়েছে। স্থান দুইটির নাম হলো ইল্লিউন আর সিজ্জীন। ইল্লিউন হলো মেহমানখানা, অর্থাৎ পৃথিবীতে যারা মহান আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করেছে, তারাই কেবল ইল্লিউনে স্থান পাবে। আর যারা পৃথিবীতে মহান আল্লাহর বিধান অমান্য করেছে, নিজের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী চলেছে, তারা স্থান পাবে সিজ্জীনে। সিজ্জীন হলো কারাগার। পবিত্র কোরআন-হাদীসে স্পষ্ট দেয়া আছে , কবরে ভোগ-বিলাস অথবা ভয়ঙ্কর আযাবের ব্যবস্থা থাকবে।
অন্যান্য ধমের মতবাদ:
জন্মান্তরবাদ বা পুনর্জন্ম আত্মা সম্পর্কিত ধারণা যা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, রসিক্রশিয়ান, থিওসফিস্ট, স্পিরিটিস্টগণ এবং উইক্কানদের ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যবস্থায় দেখা যায়। এছাড়া কাব্বালিস্টিক ইহুদি ধর্মেও পুনর্জন্মকে ‘গিলগুল নেশামত’ (আত্মার পুনর্জন্ম) নামে বর্ণনা করা হয়েছে। জন্মান্তরবাদের ধারণা অনুযায়ী, মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহে জীবন শুরু করে। মুক্তি অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত পুনর্জন্মের এই ধারা চলতে থাকে।
৩। হিন্দু ধমের, উপনিষদে জন্মান্তরবাদের উল্লেখ করা হয়েছে। সনাতন ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, দেহ একটি খোলসের ন্যায়, যার ভেতরের আত্মা অপরিবর্তনীয় ও অবিনশ্বর। হিন্দু অন্যতম ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে ভগবদ গীতায় পরকালের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেখানে কৃষ্ণ বলেছেন, ‘মানুষ যেমন তার পুরানো কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরিধান করে, তেমনি আত্মাও পুরানো দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। এই চক্রের সমাপ্তিকে মুক্তি বা মোক্ষ বলা হয।’ গরুড় পুরাণেও এর উল্লেখ আছে।
৪। বৌদ্ধ ধর্মে, মনে করা হয় মৃত্যুর পরে তাদের পুনর্জন্ম হবে এবং তখন তাদের আত্মা এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় রুপ লাভ করবে। পুনর্জন্মের ধরণ ব্যক্তির কম্ম বা কমের ওপর নিভর করবে। যেমন: ব্যক্তি যদি দেহ, বাক্য ও মনের দ্বারা লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রমের কারণে ক্ষতিকর কাজ করে, তাহলে তারা নরক জগতে থাকবে যার অর্থ হলো একটি পশু বা ভূত হয়ে জন্মানো, অন্যদিকে ব্যক্তি যদি উদারতা, ভালোবাসা, দয়া, সহানুভূতি ও জ্ঞানের দ্বারা ভালো কাজ করে তাহলে তিনি স্বর্গীয় জগতে জন্মাবেন যার অর্থ হলো মানুষ হয়ে জন্মানো।
৫। প্রাচীন ধর্মসমূহ:
প্রাচীন মিশরীয় ধর্মগুলোতে, পরকালের বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, পরকাল সম্পর্কিত এই বিশ্বাস লিখিত ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। মৃত্যুর পর আত্মা মৃতদের রাজ্যে চলে যায়। সেখানে আত্মা ফিল্ড অব অরু নামক একটি স্থানে অবস্থান করে। মৃতদের বিকল্প হিসেবে সমাধির ওপর মূর্তি তৈরি করার রীতি ছিল প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে।
গ্রিক পুরাণে বর্ণিত আছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডে রাজা হলেন হেডিস। যিনি গ্রিকদের আত্মার দেবতা। আন্ডারওয়ার্ল্ডে মৃত্যুর পর আত্মারা অবস্থান করে। গ্রীক দেবতা হার্মিস মৃতদের আত্মাকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিয়ে যান। হার্মিস আত্মাদের স্টিক্স নদী পার করে তীরে রেখে আসেন। গ্রীক পুরাণে স্টিক্স নদী হল জীবন ও মৃত্যুর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী।
রোমানদের বিশ্বাসও পরকাল বিষয়ে একইরকম। দেবতা হেডিস রোমান পুরাণে প্লুটো নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রীক পুরাণের লেবরস অব হেরাক্লেস অনুযায়ী, বীর হারকিউলিস তিন মাথাওয়ালা কুকুর সারবেরাসকে বন্দী করতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে গিয়েছিলেন। সেখানে বর্ণিত আছে সেটি ছিল আত্মার জগৎ।
বিজ্ঞান, দর্শন, প্যারাসাইকোলজী এ সকল বিষয়ের মতবাদ কিছুটা একইরকম। এরা কেউই স্পষ্টভাবে আত্মার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা করেনি। আবার এটাও বলেনি যে আত্মার কোনো অস্তিত্ব নেই।
তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বলা যায় যে আত্মার অস্তিত্ব আছে এবং প্রাণীর মৃত্যুর পর তা বিশেষ কোনো স্থানে চলে যায় যাকে ইসলামের ভাষায় আলমে বরযখ, হিন্দু ও বৌদ্ধদের ভাষায় পুনরায় ভিন্ন শরীরে জন্ম গ্রহণ করে।